মাহে রমযানের গুরুত্ব ও ফযীলত

বছরের অন্যান্য মাসের মধ্যে মাহে রমযানের অবস্থান আলাদা। এ মাসের আছে এমন কিছু বৈশিষ্ট্যতা, যা অন্যান্য মাসের নেই। ঐসব বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে যতই চিন্তা করা যায় ততই এ মাসের মহিমা ও গুরুত্ব প্রকাশিত হয়।

প্রথম বৈশিষ্ট্যতা এই যে, স্বয়ং আল্লাহ তাআলা কুরআন মাজীদে এমাসের বৈশিষ্ট্য ঘোষণা করেছেন। এটা ঠিক যে, কুরআন মাজীদে ‘আশহুরে হুরুমে’রও উল্লেখ আছে। ইরশাদ হয়েছে (তরজমা) ‘মাসের সংখ্যা আল্লাহর নিকট বারো…। তন্মধ্যে চারটি মাস হচ্ছে সম্মানিত। (সূরা তাওবা ৯ : ৩৬)

এ চার মাস হল রজব, যিলকদ, যিলহজ্ব ও মুহাররম। যদিও চার সম্মানিত মাস বলতে এই মাসগুলিই সুবিদিত এবং হাদীসের বর্ণনা অনুসারে এখানে এ চার মাসকেই বোঝানো হয়েছে। কিন্তু এ মাসগুলির নাম কুরআন মাজীদে উল্লেখিত হয়নি। এদিক থেকে মাহে রমযান বৈশিষ্ট্যতার অধিকারী। মাহে রমযানের নাম উল্লেখ করে

আল্লাহ তাআলা এর ফযীলত ঘোষণা করেছেন। ইরশাদ হয়েছে-

شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِي أُنْزِلَ فِيهِ الْقُرْآَنُ هُدًى لِلنَّاسِ وَبَيِّنَاتٍ مِنَ الْهُدَى وَالْفُرْقَانِ

অর্থাৎ, মাহে রমাযান, যাতে নাযিল করা হয়েছে কুরআন যা মানুষের জন্য হেদায়েত ও সুস্পষ্ট নির্দেশনা এবং (যা আসমানী) হেদায়েত ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্য নির্ণয়কারী (সূরা বাকারা ২ : ১৮৫)

দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্যতা, কুরআন-হাদীসে উল্লেখিত বিভিন্ন ফযীলত। কুরআন মাজীদে ও হাদীস শরীফে রমযান মাসের যে ফযীলতগুলো উল্লেখিত হয়েছে তা মূলত দু’ধরনের : ১. তাকভীনী ২. তাশরীয়ী। ‘তাকভীন’ ও ‘তাশরী’ শব্দ দুটি আরবী। দুটো শব্দই আল্লাহ তাআলার আদেশ ও ফয়সালা নির্দেশ করে। তবে দু’ধরনের আদেশ। আল্লাহ তাআলার বিধানমূলক বা করণীয়-বর্জনীয় সংক্রান্ত আদেশকে তাশরীয়ী আদেশ বলে। যেমন ঈমান আনা ও শিরক ও কুফর বর্জনের আদেশ সালাত ও যাকাতের আদেশ, সওম ও সাদাকার আদেশ ইত্যাদি। এগুলো হচ্ছে তাশরীয়ী বিধান বা বান্দার করণীয়-বর্জনীয় সংক্রান্ত বিধান। পক্ষান্তরে যেসকল আদেশ ও ফয়সালা বান্দার কর্তব্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়, বরং সৃজন, বর্ধন মর্যাদা ও বিশিষ্টতা দান, লালন ও বিলুপ্তির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সেগুলোকে বলা হয় তাকভীনী ফয়সালা। যেমন আল্লাহর আদেশেই মানুষের জীবন, আল্লাহর আদেশেই মৃত্যু। আল্লাহর আদেশেই সুস্থতা, অসুস্থতা, সন্তান-সন্ততি, ধন-সম্পদ, সম্মান-অসম্মান ইত্যাদি সব কিছু। তাঁরই আদেশে উত্থান-পতন, পরিবর্তন, পরিবর্ধন তথা বিশ্বজগতের সবকিছু। আল্লাহ তাআলার এই আদেশ ও ফয়সালাকে বলে তাকভীনী আদেশ।

মাহে রমাযানের যেসব ফযীলত কুরআন মাজীদ ও হাদীস শরীফে ঘোষিত হয়েছে তাতে যেমন তাকভীনী বিষয় আছে তেমনি আছে তাশরীয়ী বিষয়। তাকভীনী বিষয়ের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হচ্ছে, আল্লাহ তাআলা এই মাসকে নির্ধারিত করেছেন তাঁর মহিমান্বিত কালাম নাযিলের জন্য, যা জগদ্বাসীর জন্য হেদায়েত এবং হক্ব ও বাতিলের মাঝে পার্থক্যকারী। আর এ মোবারক মাসে একটি রজনীকে এমন মর্যাদা ও মহিমা দান করেছেন যে, তা হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। এ দুই বৈশিষ্ট্য কুরআন মাজীদে পরিষ্কারভাবে উল্লেখিত হয়েছে। আর হাদীস শরীফে নবী সাল্লাল্লাহু আলাআইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-

إذا جاء رمضان فتحت أبواب الجنة وغلقت ابواب جهنم وصفدت الشياطين

যখন মাহে রমাযানের আগমন হয় তখন জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয়, এবং জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করা হয়। আর শয়তানদের শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়। (সহীহ মুসলিম, হাদীস ১০৭৯)

এই হাদীস শরীফও সংবাদ দান করে যে, এ মাসে উর্ধ্ব জগতে এক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। সকল নেয়ামতের স্থান জান্নাতের দরজাসমূহ আল্লাহর আদেশে খুলে দেওয়া হয়। আর চির অশান্তির স্থান জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করা হয়। এ যেন পরওয়ারদেগারের আহবান -কে আছ, জান্নাতে যেতে চাও, আমি তাকে জান্নাতে দাখিল করব। কে আছ জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেতে চাও, আমি তাকে মুক্তি দান করব। অতএব বান্দার কর্তব্য গুনাহ ও পাপাচার থেকে পবিত্র হয়ে চিরমুক্তির পরওয়ানা হাসিল করা। বিতাড়িত শয়তানদের শৃঙ্খলাবদ্ধ করে অন্যায় অনাচারের এক বড় সূত্র বন্ধ করে দেওয়া হয়। মোটকথা গোটা মাসজুড়ে রহমত ও মাগফিরাতের ফল্গূধারা প্রবাহিত হয় এবং মুক্তির অনুকূল পরিবেশ বিরাজ করে। এগুলি হচ্ছে এই মোবারক মাসের তাকভীনী বৈশিষ্ট্য যা তাশরীয়ী বিধানসমূহ পালনে সহায়ক হয়।

এ মাসের তাশরীয়ী বৈশিষ্ট্য কী? এ মাসের তাশরীয়ী বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, দু’টি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত সওম ও তারাবী এ মাসে বিধিবদ্ধ করা হয়েছে। সূরা বাক্বারার যে আয়াতে মাহে রমযানের ফযীলত ঘোষিত হয়েছে তার আগের দু’টি আয়াতই হচ্ছে সওমসংক্রান্ত ঐ প্রসিদ্ধ আয়াত, যা এ মাসে মিম্বরে মিম্বরে পঠিত হয়-

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ

অর্থাৎ হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর ফরয করা হয়েছে রোযা, যেমন ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর। যেন তোমরা আত্মরক্ষা করতে পার। (গুনাহ থেকে এবং জাহান্নামের অগ্নি থেকে)

আল্লাহ তাআলা আরো বলেন-

فَمَنْ شَهِدَ مِنْكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ

অর্থাৎ তোমাদের মধ্যে যে এ মাসে উপস্থিত হয় সে যেন মাসভর রোযা রাখে। (সূরা বাক্বারা ২:১৮৫)

অসুস্থ ও মুসাফির ছাড়া প্রত্যেক বালিগ মুসলিমের উপর সারা মাস রোযা রাখা ফরয। এ শুধু মাহে রমাযানেরই বৈশিষ্ট্য। এ বিধান অন্য কোনো মাসে নেই।

সূরা বাকারার যে আয়াতগুলিতে রোযা ফরয হওয়ার বিধান এসেছে তাতে চিন্তা করলে দেখা যায়, একদিকে আল্লাহ রোযাকে ফরয করেছেন, অন্যদিকে অপারগতার ক্ষেত্রে অবকাশ দিয়ে এ বিধানকে সহজ করেছেন। উপরন্তু দয়াময় মালিক এ বিষয়ে এমনভাবে উৎসাহিত করেছেন যে, বান্দার জন্য তা আর কঠিন থাকেনি, মধুময় হয়ে উঠেছে।

মাহে রমাযানের দ্বিতীয় বিশেষ ইবাদত তারাবী। বলাবাহুল্য, এ-ও আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতেই প্রদত্ত। তবে দয়াময় মালিক তা দান করেছেন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ্র মাধ্যমে এবং রোযার মতো একে ফরয করেননি। হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে যে, এক রমাযানে দুই বা তিন রাত সাহাবীগণ তারাবীর নামাযে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পিছনে ইকতেদা করেছেন। অর্থাৎ তারাবীর নামায জামাতে পড়া হয়েছে। কিন্তু পরের রাতগুলোতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হুজরা থেকে বের হননি। এর কারণ দর্শিয়ে তিনি বলেছেন, তোমাদের অপেক্ষা সম্পর্কে আমি অবগত ছিলাম, কিন্তু আমার আশঙ্কা হয়েছে (এভাবে জামাতে তারাবী চলতে থাকলে) তা ফরয করে দেওয়া হতে পারে।’

হযরত আবু হুরায়রা রা. বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তারাবী নামাযকে আমাদের জন্য অপরিহার্য করেননি তবে তিনি উৎসাহিত করেছেন এবং বলেছেন, যে ব্যক্তি ঈমান ও ইহতিসাবের সাথে রমযানের রাতে (নামাযে) দাঁড়ায় তার পূর্বকৃত গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়।’ (সহীহ বুখারী, হাদীস ২০০৯

ঈমান ও ইহতিসাবের সাথে’ কথাটির মূল অর্থ, বিশ্বাসের সাথে, পুণ্যের আশায়। তো এ দু’টি ইবাদত অর্থাৎ রোযা ও তারাবী হচ্ছে মাহে রমযানের বিশেষ ইবাদত। রমযান ছাড়া অন্য কোনো মাসের রোযাকে আল্লাহ তাআলা ফরয করেননি। তেমনি অন্য কোনো মাসে তারাবী পড়ারও সুযোগ নেই।

তৃতীয় বিষয়টি সাধারণ। তা হচ্ছে গোনাহ ও পাপাচার থেকে বিরত থাকা। অন্য মাসেও তা গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু মাহে রমযানে এর গুরুত্ব আরো বেড়ে যায়। তেমনি সাধারণ ইবাদত-বন্দেগী ও আমলে ছালিহ সব সময়ই প্রশংসনীয়। কিন্তু মাহে রমাযানে এর ফযীলত অনেক বেড়ে যায়। অতএব সাধারণ ইবাদত-বন্দেগীর বিষয়ে আরো বেশি যত্নবান হওয়া এবং গুনাহ ও পাপাচার থেকে আরো গুরুত্বের সাথে বেঁচে থাকা এ মাসের করণীয়ের মাধ্যে শামিল

মাহে রমাযানের গুরুত্বের আরেকটি দিক হচ্ছে, এটি ‘শাআইরে ইসলাম’ বা ইসলামের নিদর্শনসমূহের অন্যতম। রোযার চাঁদ দেখা ও তার ঘোষণা, মসজিদে মসজিদে পয়লা রমাযান থেকেই সম্মিলিত তারাবী, সমাজের সক্ষম ও প্রাপ্ত-বয়স্ক নারী পুরুষের রোযা পালন, সাহরী ও ইফতার সব মিলিয়ে তা একটি প্রকাশ্য ও সম্মিলিত রূপ লাভ করে। রোযার মূল কাজ যদিও সম্পাদনমূলক নয় বর্জনমূলক অর্থাৎ পানাহার বর্জন, তাই মূল কাজটি দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়ে ওঠে। অন্য মাসের সাথে এ মাসের পরিবর্তনটা বেশ চোখে পড়ে। এসব বিষয় বিবেচনা করলে মাহে রমযান ইসলামের অন্যতম শি‘আর হওয়া পরিষ্কার হয়ে যায়।

কুরআন মাজীদে ‘আশহুরে হুরুমকে শি‘আর হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। অথচ আশহুরে হুরুমের মূল বৈশিষ্ট্য দু’টি : এক. প্রাচীনকাল থেকেই এ মাসগুলিতে যুদ্ধ-বিগ্রহ, রক্তপাত নিষিদ্ধ থাকা। বলাবাহুল্য, এটি একটি বর্জনমূলক বিষয়। দুই. আশহুরে হজ্ব বা হজ্বের মূল মাসগুলি আশহুরে হুরুমের অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ, যিলক্বদ, যিলহজ্ব। আর হজ্ব সম্মিলিতভাবে সম্পাদনমূলক একটি ইবাদত। মোটকথা, শরীয়তের নীতিমালার অলোকে মাহে রমাযান শা‘আইরে ইসলামের অন্তুর্ভুক্ত। অতএব এ মাসের মর্যাদা রক্ষা অতি গুরুত্বপূর্ণ।

শাআইর বা আল্লাহ তাআলার বন্দেগীর নিদর্শনসমূহের বিষয়ে কুরআন মজীদে বলা হয়েছে-

ذَلِكَ وَمَنْ يُعَظِّمْ شَعَائِرَ اللَّهِ فَإِنَّهَا مِنْ تَقْوَى الْقُلُوبِ

আর যারা আল্লাহ তাআলার (ইবাদতের) নিদর্শনসমূহকে সম্মান করে এ (তাদের) অন্তরের খোদাভীতি থেকে উৎসারিত।’ (সূরা হজ্ব : ২২ : ৩২)

মাহে রমযানের মর্যাদা কীভাবে অক্ষুণ্ণ রাখা যাবে

এ মাসের মর্যাদা রক্ষার জন্য প্রথম করণীয়, আল্লাহ তাআলা এ মাসে ইবাদতের যে বিধান দিয়েছেন এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে ইবাদত সুন্নাহ করেছেন, অর্থাৎ রোযা ও তারাবী তা যথাযথভাবে আদায়ে সচেষ্ট হওয়া।

২. শরীয়তসম্মত ওযরবশত পানাহার করতে হলে প্রকাশ্যে না করা।

চিন্তা করার বিষয় এই যে, অনেক ক্ষেত্রে শরীয়তে ‘তাশাববুহ বিস সা-ইমীন’(রোযাদারগণের সাদৃশ্য গ্রহণ)-এর বিধান আছে। এর তাৎপর্য রমাযানের মর্যাদা রক্ষা করা। যেমন মুসাফিরের জন্য রোযা না-রাখার অবকাশ থাকলেও কোনো মুসাফির যদি দিনের বেলা মুকীম হয়ে যায় তাহলে তার কর্তব্য, অবশিষ্ট দিন পানাহার থেকে বিরত থাকা। এতে কি রোযা হবে? রোযা হবে না, কিন্তু রোযার মর্যাদা রক্ষা হবে। তেমনি হায়েয বা নিফাসের অবস্থায় মহিলাগণ রোযা রাখতে পারেন না, কিন্তু কোনো মহিলা যদি দিনের বেলায় হায়েয বা নিফাস থেকে পবিত্র হন তাহলে তার কর্তব্য, বাকী দিন পানাহার থেকে বিরত থাকা। (যদিও হায়েয বা নিফাসগ্রস্ত অবস্থায় তার পানাহারের অনুমতি আছে। তবে সেক্ষেত্রেও নিয়ম হল গোপনে পানাহার করা।) একে ‘তাশাববুহ বিস সা-ইম’ বলে। অর্থাৎ রোযাদারের সাদৃশ্য অবলম্বন। এ বিধান তো রমযানের মর্যাদার জন্যই দেওয়া হয়েছে।

চিন্তা করার বিষয় এই যে, অনেক ক্ষেত্রে শরীয়তে ‘তাশাববুহ বিস সা-ইমীন’(রোযাদারগণের সাদৃশ্য গ্রহণ)-এর বিধান আছে। এর তাৎপর্য রমাযানের মর্যাদা রক্ষা করা। যেমন মুসাফিরের জন্য রোযা না-রাখার অবকাশ থাকলেও কোনো মুসাফির যদি দিনের বেলা মুকীম হয়ে যায় তাহলে তার কর্তব্য, অবশিষ্ট দিন পানাহার থেকে বিরত থাকা। এতে কি রোযা হবে? রোযা হবে না, কিন্তু রোযার মর্যাদা রক্ষা হবে। তেমনি হায়েয বা নিফাসের অবস্থায় মহিলাগণ রোযা রাখতে পারেন না, কিন্তু কোনো মহিলা যদি দিনের বেলায় হায়েয বা নিফাস থেকে পবিত্র হন তাহলে তার কর্তব্য, বাকী দিন পানাহার থেকে বিরত থাকা। (যদিও হায়েয বা নিফাসগ্রস্ত অবস্থায় তার পানাহারের অনুমতি আছে। তবে সেক্ষেত্রেও নিয়ম হল গোপনে পানাহার করা।) একে ‘তাশাববুহ বিস সা-ইম’ বলে। অর্থাৎ রোযাদারের সাদৃশ্য অবলম্বন। এ বিধান তো রমযানের মর্যাদার জন্যই দেওয়া হয়েছে।

আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় হচ্ছে আনুগত্য ও সমর্পণ, আর সবচেয়ে অপ্রিয় অবাধ্যতা ও বিদ্রোহ। তাই অন্তরের অবাধ্যতার মতো বাহ্যিক অবাধ্যতা থেকেও আত্মরক্ষা প্রয়োজন। এমনকি অবাধ্যতার সামান্য সাদৃশ্য থেকে বেঁচে থাকাও মুমিনের কর্তব্য। ইসলামে সাদৃশ্যের গুরুত্ব অনেক বেশি। মশহুর হাদীস-

من تشبه بقوم فهو منهم

অর্থাৎ যার সাদৃশ্য যে সম্প্রদায়ের সঙ্গে বস্ত্তত সে তাদেরই একজন।’

৩. যেসব গুনাহের কাজ প্রকাশ্যে ও ব্যাপকভাবে করা হয় সেগুলো থেকে নিজেও বিরত থাকা, অন্যকেও বিরত রাখা। যেমন গান-বাজনা, প্রাণীর ছবি ও প্রাণীমূর্তির প্রদর্শনী, বেপর্দা চলাফেরা ইত্যাদি।

৪. দিনের বেলা হোটেল-রেস্তোরাঁয় পানাহার বন্ধ রাখা।

৫. পুরুষেরা পাঁচ ওয়াক্ত নামায মসজিদে জামাতে আদায় করা। এ সময় বাইরে ঘোরাঘুরি, আড্ডা, গল্প-গুজব ও অন্যান্য কর্মব্যস্ততা থেকে বিরত থাকা।

এরকম আরো বিষয় আছে। সর্বশেষ যে বিষয়টি বলে এ লেখা শেষ করছি তা হচ্ছে, দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে এ মাসকে দরিদ্র ও মধ্যবিত্তের জন্য কষ্টের মাসে পরিণত না করা। অন্তত মুসলিম ব্যবসায়ী ও ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দের তো কিছুটা ‘ত্যাগ’ স্বীকার করে হলেও এদিকে নজর দেয়া অতি জরুরি।

রোযায় শুকরগোযারির প্রশিক্ষণ

বান্দার শুকর ও কৃতজ্ঞতা আল্লাহ রাববুল আলামীনের বড় পছন্দ। তিনি চান বান্দা প্রতিটি ক্ষেত্রে তাঁর শুকরআদায় করুক, যাতে তিনি নিআমতে-অনুগ্রহে তাকে ভরিয়ে দিতে পারেন এবং যা দিয়েছেন, বাড়তি দান দ্বারা তাকে পরিপূর্ণ করে তুলতে পারেন। যত শুকর ততোধিক দান-এটাই তাঁর বিধান। তিনি এর নিশ্চয়তা দিয়েবলেন-

لئن شكرتم لازيدنكم

তুমি যদি শুকর আদায় কর, আমি তোমাকে আরও বেশি দেব। শুকরগোযার হওয়ার জন্য এটা এক ঐশী প্রণোদনা। এ রকম অনুপ্রেরণাদায়ী আয়াত কুরআন মজীদের পাতায় পাতায় চোখে পড়ে। মহানবী সাল্লাল্লাহুআলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদীসও আছে প্রচুর। জ্ঞানবান ও বুদ্ধিমানের জন্য তাতে শুকরগোযারির যথেষ্ট সবক রয়েছে। কিন্তু দয়াময় আল্লাহ বান্দাকে তো জানেন। আলস্য ও উদাসীনতা তার মজ্জায় মেশানো। বড় আনমনা।মনের সংযোগ ছাড়া তো সবক হাসিল হয় না। তাই মনোযোগ সৃষ্টির জন্য চোখের সামনে খুলে দিয়েছেন নানাদৃশ্যপট, যা দেখলেই মনে কৃতজ্ঞতা জাগার কথা। প্রতিটি মানুষের সামনেই এমন কত দৃশ্যই না বিরাজ করে, যা তার বহুবিধ সম্পন্নতা স্মরণ করিয়ে দেয়, যেন বলে দেয়-আহা, চেয়ে দেখ তোমার কত আছে! শিক্ষানবিস মনঠিকই তা থেকে সবক গ্রহণ করে। সে কৃতজ্ঞতায় আনত হয়ে বলে ওঠে-

اللهم لك الحمد ولك الشكر

রাববুল আলামীনের শিক্ষা কারিকুলাম বড় বিচিত্র এবং তা অতি পূর্ণাঙ্গ। তিনি ছবির সাহায্যে শিক্ষা দিয়েই ক্ষান্তহননি। তিনি বান্দাকে হাতে-কলমেও শুকরের তালিম দিয়েছেন। বাস্তব প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শুকরগোযাররূপে গড়ে তোলার ব্যবস্থা করেছেন। দৈনন্দিন জীবনের ঘটনাপ্রবাহ ও বয়ে চলা জিন্দেগীর চড়াই-উৎরাইয়ের প্রতিলক্ষ্য করুন না, একি কেবলই প্রাকৃতিক আয়ু পূরণের চলমানতা? এর ভেতর কি কোন পরিকল্পিত নির্মাণ নেই?এ কালক্ষয় নয় কি কোন পূর্ণতা বিধানের সুব্যবস্থিত প্রক্রিয়া? আচরিত জীবনে বান্দা যত অবস্থার সম্মুখীন হয়,তার প্রতিটি দ্বারাই মহান আল্লাহ মূলত বান্দাকে তাঁর সত্যিকারের বান্দারূপে গড়ে তোলার বাস্তব প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন। বান্দা যদি তাতে নিজ ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করে তবে এ প্রশিক্ষণের সুফল সে পাবেই। ওই ইচ্ছাশক্তির প্রয়োগটুকু তার দরকার, যেহেতু সে জড় নয়, বুদ্ধিমান জীব। বান্দা ইচ্ছা করলে তার প্রতিটি হাল থেকেই নিজেকে কৃতজ্ঞরূপে গড়ে তোলার প্রশিণ নিতে পারে। কিন্তু পার্থিব জীবনে মোহাচ্ছন্ন মানুষ বড় স্থূলদর্শী।

আপাতদৃষ্টির সীমাবদ্ধতা ছাড়িয়ে সে নিজেকে আরও বিস্তার ও আরও গভীরে নিয়ে যেতে পারে না বা নিয়ে যেতে চায় না। ফলে সে কুদরতি প্রশিক্ষণের সুফল ভোগ থেকে বঞ্চিত থেকে যায়। কিন্তু সে কি চিরবঞ্চিতই থেকে যাবে? দয়াময় আল্লাহ তাআলার ইচ্ছা সে রকম নয়। তিনি দিতেই চান। সুতরাং পরবর্তী ধাপরূপে তিনি বাধ্যতামূলক কিছু কর্মসূচি দিয়েছেন, যা পালন করলে মানুষ বাস্তবিক শুকরগোযার বান্দা হয়ে ওঠতে পারে। সেই কর্মসূচির অন্যতম প্রধান অংগ রমযানের রোযা।

রোযার অপর নাম সবর। রোযায় সবরের প্রশিণ হয় সরাসরি এবং তা অতি স্পষ্ট। কিন্তু এতে যে শুকরেরও সবক বরং প্রশিক্ষণ রয়েছে সেদিকে নজর কমই যায়। অথচ এ প্রশিক্ষণও অস্পষ্ট নয়।

যা যা থেকে বিরত থাকার দ্বারা রোযা হয় তা অতি বড় নিআমত। খাদ্য যে কত বড় নিআমত তা কে না বোঝে?বরং নিআমত বললে প্রথম নজরটাই খাদ্যের দিকে যায়, যেহেতু এর দ্বারা প্রাণ রক্ষা হয়। আর পানির অপরনামই তো জীবন। তৃতীয় জিনিস স্ত্রী নিবিড়তা হল জীবনাগম ও জীবন বিস্তারের উপায়। সুতরাং এটাও অনেক বড় নিআমত। কিন্তু এসব নিআমত সহজলভ্য ও অনায়াসভোগ্য হওয়ায় এর উপলব্ধি খুব জাগন্ত নয়। তাই কমমানুষই এর জন্য শুকর আদায় করে। আর করলেও শুকরের ভাষাগত উচ্চারণকেই অধিকাংশ লোক যথেষ্ট মনেকরে। ঠিক প্রাণ দিয়ে অনুভব করে না দয়াময়ের কী মূল্যবান দান সে সতত ভোগ করে যাচ্ছে! বস্ত্তত রোযা সেই অনুভব সৃষ্টির অতি উত্তম ব্যবস্থা।

রোযা রাখার দ্বারাই উপলব্ধি করা যায় খাদ্য-পানি কত দরকারি জিনিস। পেটেুক্ষুধা, বুকে তৃষ্ণা, অথচ পানাহার দ্বারা তা নিবারণ করা যাচ্ছে না। দীর্ঘ সময় এ কষ্ট বরদাশত করতে হচ্ছে আর ক্রমেই কষ্ট তীব্রতর হচ্ছে।অন্যসময় হলে তো ক্ষুৎ পিপসা আঁচ করা মাত্র তা নিবারণের চেষ্টা করা হত, কিন্তু এ সময় প্রবৃত্তির যতই চাহিদা হোক এবং শারীরিক যত কষ্টই হোক পানাহার বারণ। ফলে বান্দা চাহিদা দমন করে কষ্ট সয়েই যায়। এভাবেই সময় বয়ে যেতে থাকে। পরিশেষে সূর্যাস্ত কালে যখন ইফতার সামগ্রি নিয়ে বসা হয় তখন দিনমানের দমিত সেই চাহিদার উচ্ছ্বসিত স্ফূরণে অকিঞ্চিতকর খাবারও অমৃতসম মনে হয়। তখন সামনে যা-ই থাকে, পরম সমাদরে তা গ্রহণ করা হয়। এক পেয়ালা পানিতে হৃদয়-মন জুড়িয়ে যায়। রুখা শিরা-উপশিরায় প্রাণরস সিঞ্চিত হয় আর অনাহারক্লিষ্ট শরীর শক্তি-সজীবতা ফিরে পায়। অকস্মাৎ খুলে যায় চেতনার দ্বার। অনুভব-উপলব্ধির উন্মেষেতখন বুঝে আসে পানির কদর আর খাদ্যের মূল্য। এ ছাড়া যে জীবন বাঁচে না, এর সাময়িক অভাবেও যে দেহমন চলচ্ছক্তি হারায়, সে সত্য তখন হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যায়। তা দেহকে সচল রাখা ও জীবনকে রক্ষা করার এই অমূল্য অবলম্বন আল্লাহরই তো দান! কত দয়াময় মহান আল্লাহ, যিনি আমাদের জীবন রক্ষার ও আমাদের দেহমনে শক্তি যোগানোর জন্য কত অফুরান নিআমত বিশ্ব চরাচরে ছড়িয়ে দিয়েছেন! হররোজ-হরদম আমরা কত সহজে-সাচ্ছন্দ্যে তা ভোগ করে যাচ্ছি! কতটা আনন্দ, কতটা তৃপ্তি, কতটা সুখ-সুধায় আপ্লুত এ জীবন।সুতরাং শুকর আল্লাহর! অশেষ শুকর তাঁর। শুকর এত সব নিআমত দানের জন্য। শুকর এ নিআমতের উপলব্ধি দানের জন্য এবং শুকর তাঁর শুকরগোযারির প্রশিক্ষণ দানের জন্য। রোযা আমাদের অন্তরে এ উপলব্ধিকে উজাগর করারই এক উপযুক্ত প্রশিক্ষণ। রোযা রেখেই আমরা বুঝতে পারি পানির মূল্য। উপলব্ধি করতে পারিখাদ্যের কদর। এ উপলব্ধির সত্যিকার স্ফূরণ ঘটে ইফতারকালে। তাই ইফতারের সময়টা শুকর ও কৃতজ্ঞতায় আনত হওয়ার সময়। এ সময় প্রাণখুলে শুকর আদায় করা চাই। ভক্তি-রসে স্নাত কণ্ঠে বলে ওঠা চাই-

اللهم لك الحمد ولك الشكر

হে আল্লাহ! তোমারই সব প্রশংসা। তোমাকেই জানাই সব কৃতজ্ঞতা।

اللهم لك صمت وعليك توكلت وعلى رزقك أفطرت

হে আল্লাহ! তোমারই জন্য রোযা রেখেছি, তোমারই উপর নির্ভর করেছি এবং তোমারই দেওয়া রিযিক দ্বারাইফতার করেছি।

তোমার দেওয়া নিআমতে ঘুচে গেছে সারাদিনের সব ক্লান্তি। নিবারণ হয়েছে ক্ষুধা-পিপাসা। দেহমনে ছেয়ে গেছেশান্তি ও প্রশান্তি-

ذهب الظمأ وابتلت العروق وثبت الأجر إن شاء الله

হে আল্লাহ! পিপাসা মিটে গেছে, শিরাগুলো সিঞ্চিত হয়েছে আর ইনশাআল্লাহ ছওয়াব তো আছেই।

এভাবে টানা এক মাস চলে নিআমতের মূল্য বোঝা ও শুকর আদায়ের প্রশিক্ষণ। দিনের বেলা পানাহার বর্জনকরে ক্ষুৎ পিপাসার কষ্টভোগ ও সেই কষ্টভোগের মাধ্যমে জীবনের জন্য খাদ্য-পানীয়ের প্রয়োজনীয়তা অনুভব,পরিশেষে ইফতার করে ক্ষুৎ পিপাসার কষ্ট নিবারণ ও তা নিবারণের মাধ্যমে খাদ্য-পানীয়ের মহিমা হৃদয়ঙ্গম-এধারাতেই রোযাদারের মন শুকরগোযারির অনুপ্রেরণা পায় এবং শুকরের ভাষা হৃদয়-মন ছাপিয়ে চোখে-মুখেবাঙময় হয়ে ওঠে।

টানা একমাস এবং মাত্র এক মাস। মাসের শেষদিকেই শরীর জবাব দিতে শুরু করে দেয়। তারপর আরও রোযা হলে বড় কষ্ট হত। দয়াময় আল্লাহ সে কষ্ট হতে বান্দাকে মুক্তি দিয়েছেন। এমনকি মাসের ভেতরেও যদি কষ্ট সীমা ছাড়িয়ে যায় অর্থাৎ অসুস্থতা, বার্ধক্য বা অতিরিক্ত দুর্বলতার কারণে রোযা রাখা সম্ভব না হয় তবে রোযা রাখার ফযীলত থেকে বান্দা যাতে বঞ্চিত না হয় সে সুযোগও রাখা হয়েছে। কাযা বা ফিদয়ার সে সুবিধাও তাঁর আরেক নিআমত। কৃতজ্ঞতাবোধকে বিকশিত করে তোলার এও আরেক সুযোগ। অপারগতার ক্ষেত্রে রমযানের রোযার যদি কোন বিকল্প না থাকত, তবে বান্দা পেত কি মননশীলতা চর্চার এ সুযোগ? কিংবা যদি সারা বছরই থাকত রোযা, তবে অখন্ড চর্চায় সম্ভব হত কি নিজেকে জুড়ে রাখা? সুতরাং বান্দা, শুকর আদায় কর আল্লাহ প্রদত্ত এসুবিধার জন্য। শুকরগোযারিই এ সুবিধার লক্ষ্য। ইরশাদ হয়েছে-‘আল্লাহ তোমাদের পক্ষে যা সহজ সেটাই করতে চান। তোমাদের জন্য জটিলতা সৃষ্টি করতে চান না, যাতে তোমরা রোযার সংখ্যা পূরণ করে নাও এবং আল্লাহ তোমাদেরকে যে পথ দেখিয়েছেন সেজন্য আল্লাহর তকবীর পাঠ কর এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। (বাকারা :১৮৫)

রমযানের পর রোযা ফরয না থাকার ফলে রোযার অন্যান্য শিক্ষার সাথে শুকরগোযারির শিক্ষাকেও কাজে লাগানোর সুযোগ লাভ হয়েছে। যখনই পিপাসা তখনই পানি পান এবং যখনই খিদে তখনই খাদ্য গ্রহণ করতে পারার ফলে অন্তরে এই কৃতজ্ঞতাবোধ জাগ্রত হতে পারে যে, ইয়া আল্লাহ! জীবনরক্ষা ও দেহমনে শক্তি যোগানোরএই যে আয়োজন, এতো তোমারই দান। রোযা রাখিয়ে তুমি বুঝিয়ে দিয়েছ, তোমার এ দান কত মূল্যবান এবং কত প্রয়োজনীয়! সেই মহামূল্যবান নিআমত আবার এই দিনগুলিতে করে দিয়েছ অবারিত। এখন যখনই ইচ্ছা ও যখনই প্রয়োজন তা ভোগ করতে পারছি। নেই পরিমিত চাহিদা দমনের চাপ, নেই

প্রয়োজন পূরণে বারণ-বাধা। কতই

না অনুগ্রহ তোমার। সুতরাং

اللهم لك الحمد ولك الشكر

এভাবে রমযানে রোযা রাখার দ্বারা পানাহার সামগ্রির নিআমত বোঝা ও তার শুকর আদায়ের যে সবক ও প্রশিক্ষণ লাভ হয়েছে তার বদৌলতে সারা বছরই বান্দা এ নিআমতের জন্য শুকরগোযার হয়ে চলতে পারে। সেইসঙ্গে অপরাপর নিআমতের জন্যও। কেননা এক নিআমত তো অন্য নিআমতেরও স্মারক। রোযা রাখার সাথে সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গসহ শারীরিক সুস্থতা, জানমালের নিরাপত্তা, দারা-পরিবার সকলের পারস্পরিক সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি মোটকথা শান্তিপূর্ণ জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছুরই সম্পর্ক রয়েছে। আর আল্লাহ তাআলা যেহেতু নিজ দয়ায় এসব কিছুর ব্যবস্থা করেছেন তখন রোযার মাধ্যমে যে কৃতজ্ঞতাবোধের উন্মেষ ও বিকাশ নিজ চরিত্রে সাধিত হয়ে যায়, সকল ক্ষেত্রেই তার স্বাক্ষর রাখা সম্ভব হয়ে ওঠে। কিন্তু বান্দা সে সম্ভাবনাকে কাজে লাগায়কি? কিংবা ঠিক কতজন তা কাজে লাগায়? আল্লাহ তাআলা আক্ষেপের ভাষায় বলেন-

وقليل من عبادى الشكور

আমার শুকরগোযার বান্দা বড় কম।

হে আল্লাহ! বোঝা যাচ্ছে কম হলেও তোমার শুকরগোযার বান্দা বাস্তবে আছে। তুমি নিজ দয়ায় আমাকে ও আমার সকল বন্ধুদেরকে সেই অল্পসংখ্যকদের কাতারভুক্ত করে নাও। [ আমিন]

 

 কুরআন মজীদ ও সহীহ হাদীসের আলোকে রমাযানুল মুবারক

হিজরীবর্ষের নবম মাসটির নাম রমাযানুল মুবারক। এ মাসের মর্যাদা ও মাহাত্ম্য বলার অপেক্ষারাখে না। এ মাস আল্লাহ তাআলার অধিক থেকে অধিকতর নৈকট্য লাভের উত্তম সময়, পরকালীন পাথেয় অর্জনের উৎকৃষ্ট মৌসুম। ইবাদত-বন্দেগী, যিকির-আযকার এবং তাযকিয়া ও আত্মশুদ্ধির ভরা বসন্ত। মুমিন বান্দার জন্য রমযান মাস আল্লাহ তাআলার অনেক বড় নেয়ামত। তিনি এই মাসের প্রতিটি দিবস-রজনীতে দান করেছেন মুষলধারা বৃষ্টির মত অশেষ খায়ের-বরকত এবংঅফুরন্ত কল্যাণ। মুমিনের কর্তব্য, এই মহা নেয়ামতের জন্য কৃতজ্ঞ ও আনন্দিত হওয়া।

ইরশাদ হয়েছে-

قُلْ بِفَضْلِ اللَّهِ وَبِرَحْمَتِهِ فَبِذَلِكَ فَلْيَفْرَحُوا هُوَ خَيْرٌ مِمَّا يَجْمَعُونَ

(তরজমা) (হে নবী) আপনি বলুন! এটা আল্লাহর অনুগ্রহ ও তাঁর রহমতেই হয়েছে। সুতরাং এতে তারা যেন আনন্দিত হয়। তারা যা কিছু সঞ্চয় করে, এটা তার চেয়ে উত্তম।-সূরা ইউনুস (১০)-৫৮

এ মাসে বান্দা পার্থিব সকল চাহিদা বিসর্জন দিয়ে আল্লাহর দয়া ও রহমত লাভ করবে, অতীতের সকল পাপাচার থেকে ক্ষমা চেয়ে নতুনভাবে ঈমানী জিন্দেগীর উত্তাপ গ্রহণ করবে, তাকওয়ার অনুশীলনের মাধ্যমে পুরো বছরের ইবাদত ও ইতাআতের শক্তি সঞ্চয় করবে, চিন্তা-চেতনা ও কর্ম-সাধনায় আল্লাহর আনুগত্যে নিজেকে সমর্পিত করবে-এই হচ্ছে মুমিনের আনন্দ।

আল্লাহ তাআলা এই পবিত্র মাসকে যেসব গুণ ও মর্যাদা দ্বারা বৈশিষ্ট্যমন্ডিত করেছেন, যত রহমত,বরকত এবং দয়া ও অনুগ্রহ দ্বারা একে মহিমান্বিত করেছেন, এ মাসের নেক আমলগুলোর যত সওয়াব ও প্রতিদান নির্ধারিত করেছেন তার হিসাব-নিকাশ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। তবুওকুরআন মজীদের বিভিন্ন আয়াতে এবং হাদীস শরীফের বিস্তৃত বর্ণনায় যে গুরুত্ব ও বৈশিষ্ট বর্ণিত হয়েছে, তার কিছু দৃষ্টান্ত এখানে উল্লেখ করার চেষ্টা করব। আল্লাহ তাআলা সবাইকে উপকৃতক রুন। আমীন।

 

১. সিয়াম ও কিয়ামের মাস

মুসলিম উম্মাহর নিকট রমযান মাসের আগমন ঘটে প্রধানত রোযা ও তারাবীহ’র বার্তা নিয়ে।এটি রমযান মাসের বিশেষ আমল। তাই প্রত্যেক মুমিনের কর্তব্য, পূর্ণ নিষ্ঠা ও

আন্তরিকতার সাথে এ দুই বিষয়ে যত্নবান হওয়া।

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন-

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ

হে মুমিনগণ! তোমাদের উপর রোযা ফরয করা হয়েছে, যেমন ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের প্রতি; যাতে তোমরা তাক্বওয়া অবলম্বনকারী (মুত্তাকী) হতে পার।-সূরা বাকারা (২)১৮৩- অন্য আয়াতে

ইরশাদ করেছেন,

فَمَنْ شَهِدَ مِنْكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ وَمَنْ كَانَ مَرِيضًا أَوْ عَلَى سَفَرٍ فَعِدَّةٌ مِنْ أَيَّامٍ أُخَرَ

সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি এ মাস (রমযান) পাবে, সে যেন অবশ্যই তার রোযা রাখে। আর তোমাদের মধ্যে কেউ যদি অসুস্থ হয় বা সফরে থাকে, তবে অন্য সময় সে সমান সংখ্যা পূরণ করবে।-সূরা বাকারা-১৮৫

হযরত আবু হুরায়রা রা বলেন,

لما حضر رمضان، قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : قد جاءكم رمضان، شهر مبارك، افترض الله عليكم صيامه، تفتح فيه أبواب الجنة، وتغلق فيه أبواب الجحيم، وتغل فيه الشياطين، فيه ليلة خير من ألف شهر، من حرم خيرها فقد حرم. قال الشيخ شعيب الارنؤوط فى تعليقه على المسند : هذا حديث صحيح، وإسناد رجاله رجال الشيخين.

যখন রমযান মাসের আগন ঘটলো, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করলেন, তোমাদের নিকট বরকতময় মাস রমযান এসেছে। আল্লাহ তাআলা তোমাদের জন্য এমাসের রোযা ফরয করেছেন। এ মাসে জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। আর শয়তানদেরকে শিকলে বন্দী করা হয়। এ মাসে এমন একটি রাত আছে, যা হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। যে এর কল্যান থেকে বঞ্চিত হল, সে তো প্রকৃত পক্ষেই বঞ্চিত।-মুসনাদে আহমদ, হাদীস-৭১৪৮ সুনানে নাসায়ী-হাদীস-২৪১৬, মুসান্নাফে আবদুররাযযাক, হাদীস ৮৩৮৩ মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা, হাদীস ৮৯৫৯

 

২. কুরআন নাযিলের মাস

রমাযানুল মুবারকের আরেকটি বড় বৈশিষ্ট্য হল তা কুরআন নাযিলের মাস। এই পবিত্র মাসেই আল্লাহ তাআলা পূর্ণ কুরআন মজীদ লওহে মাহফুয থেকে প্রথম আসমানে অবতীর্ণ করেন। অতপর রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট কুরআনের সর্বপ্রথম অহীও এ মাসেই নাযিলহয়। রমযান মাসের অন্য কোনো ফযীলত যদি উল্লেখিত না হত, তবে এই এক ফযীলতই তার মর্যাদা ও বিশেষত্বের জন্য যথেষ্ট হতো। রমযান মাসের পরিচয় ও গুরুত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে আল্লাহতাআলা সর্বপ্রথম এই বৈশিষ্ট্যের কথাই উল্লেখ করেছেন।

ইরশাদ হয়েছে-

شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِي أُنْزِلَ فِيهِ الْقُرْآَنُ هُدًى لِلنَّاسِ وَبَيِّنَاتٍ مِنَ الْهُدَى وَالْفُرْقَانِ فَمَنْ شَهِدَ مِنْكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ

(তরজমা) রমযান মাস, যাতে কুরআন নাযিল হয়েছে, যা মানুষের জন্য হেদায়েত এবং সুপথপ্রাপ্তির সুস্পষ্ট পথনির্দেশ আর হক্ব-বাতিলের মধ্যে পার্থক্যকারী। সুতরাং তোমাদের যে কেউ এ মাসপাবে সে যেন অবশ্যই এর রোযা রাখে।-সূরা বাকারা (২) : ১৮৫

শুধু কুরআন মজীদ নয়, হযরত ইবরাহীম আ. এর সহীফা, তাওরাত, যবুর, ইঞ্জিলসহ সকলআসমানী কিতাব এ মাসে অবতীর্ণ হয়েছে। তাবারানী বর্ণিত একটি সহীহ হাদীসে এই বৈশিষ্ট্যওউল্লেখিত হয়েছে।

 ৩. মুসলমানদের জন্য সর্বোত্তম মাস।

হযরত আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন,

ما اتى على المسلمين شهر خير لهم من رمضان ولا اتى على المنافقين شهر شرلهم من رمضان، وذلك لمايعد المؤمنون فيه من القوة للعبادة وما يعد فيه المنافقون من عفلات الناس وعوراتهم هو غنم المؤمن يغتنمهالفاجر.

قال الشيخ احمد شاكر فى تعليقه على المسند (8350) اسناده صحيح وفى (8856) اسناده حسن لغيره.

আল্লাহ তাআলার কসম! মুসলমানদের জন্য রমযানের চেয়ে উত্তম কোনো মাস আসেনি এবংমুনাফিকদের জন্য রমযান মাসের চেয়ে অধিক ক্ষতির মাসও আর আসেনি। কেননা মুমিনগণ এমাসে (গোটা বছরের জন্য) ইবাদতের শক্তি ও পাথেয় সংগ্রহ করে। আর মুনাফিকরা তাতে মানুষের উদাসীনতা ও দোষত্রুটি অন্বেষণ করে। এ মাস মুমিনের জন্য গনীমত আর মুনাফিকের জন্য ক্ষতির কারণ।-মুসনাদে আহমদ, হাদীস ৮৩৬৮, মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা, হাদীস-৮৯৬৮,সহীহ ইবনে খুযাইমা, হাদীস-১৮৮৪, তাবারানী হাদীস-৯০০৪, বাইহাকী শুয়াবুল ঈমান,হাদীস-৩৩৩৫     

৪. রহমতের মাস।

এ মাসে জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়। আর শয়তানদেরকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়।

ইতিপূর্বে উল্লেখিত একটি হাদীসে এ বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে। এ ছাড়া আরো হাদীসে তা আছে।

হযরতআবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

إذا جاء رمضان فتحت أبواب الجنة، وغلقت أبواب النار، وصفدت الشياطين.

যখন রমযান মাসের আগমন ঘটে, তখন জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। আর শয়তানদেরকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়।-সহীহ বুখারী,হাদীস-১৮৯৮, সহীহ মুসলিম, হাদীস-১০৭৯ (১), মুসনাদে আহমদ হাদীস-৮৬৮৪, সুনানেদারেমী, হাদীস-১৭৭৫

হযরত আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

إذا كان رمضان فتحت أبواب الرحمة، وغلقت أبواب جهنم، وسلسلت الشياطين.

وفي رواية البخاري : إذا دخل شهر رمضان، فتحت أبواب السماء …

রমযান মাস শুরু হলেই রহমতের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয়, জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করেদেওয়া হয় এবং শয়তানদেরকে শিকলে আবদ্ধ করা হয়।-সহীহ মুসলিম হাদীস-১০৭৯-২

সহীহ বুখারী’র বর্ণনায় রয়েছে, রমযান আরম্ভ হলে আসমানের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয়, …।হাদীস-১৮৯৯

মুহাদ্দিসীনে কেরাম বলেন, মুমিন বান্দাগণ যাতে রমযান মাসের অতি মূল্যবান ও বরকতপূর্ণ সময়কে কাজে ব্যয় করতে পারে এবং মুনাফিকদের মত খায়ের ও বরকত থেকে বঞ্চিত না থাকে, তাইআল্লাহ তাআলা এ মাসের শুরু থেকেই সৃষ্টিজগতে এমন আবহ সৃষ্টি করেন, যা পুরো পরিবেশকেই রহমত-বরকত দ্বারা আচ্ছাদিত করে দেয় এবং মুমিনদেরকে ইবাদত-বন্দেগী ও নেক আমলের উৎসাহ-উদ্দীপনা জোগাবে। তাদের পূণ্য ও প্রতিদানের সুসংবাদ দিতে জান্নাতের দরজাসমূহ খুলেদেওয়া হয় এবং পাপাচার ও খারাপ কাজ হতে বিরত রাখতে জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করেদেওয়া হয়। সব ধরনের ফিতনা-ফাসাদ ও অনিষ্ট হতে রক্ষা করতে কুমন্ত্রণাদাতা দুষ্ট জ্বিন ওশয়তানদেরকে শিকল লাগিয়ে আবদ্ধ করা হয়। তারপর কল্যাণের পথে অগ্রগামী হওয়ার ও অন্যায়থেকে নিবৃত্ত থাকার আহবান জানানো হয়।

যেমন আবু হুরায়রা রা. থেকেই বর্ণিত এক হাদীসেআছে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

إذا كان أول ليلة من شهر رمضان صفدت الشياطين ومردة الجن، وغلقت أبواب النار، فلم يفتح منها باب،وفتحت أبواب الجنة، فلم يغلق منها باب، وينادي منادٍ : يا باغي الخير! أقبل، ويا باغي الشر! اقصر، ولله عتقاءمن النار، وذلك كل ليلة.

যখন রমযান মাসের প্রথম রাতের আগমন ঘটে, তখন দুষ্ট জ্বিন ও শয়তানদের শৃঙ্খলাবদ্ধ করাহয়। জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেওয়া হয়, তার একটি দরজাও খোলা হয় না এবংজান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয়, তার একটি দরজাও বন্ধ করা হয় না। আর একজন ঘোষক ঘোষণা করতে থাকে-হে কল্যাণের প্রত্যাশী! অগ্রসর হও, হে অকল্যাণের প্রার্থী! থেমে যাও।

আরআল্লাহ তাআলা এ মাসের প্রতি রাতে অসংখ্য জাহান্নামীকে মুক্তি দান করেন।-মুসনাদে আহমদ,হাদীস ১৮৭৯৪, ; বাইহাকী শুয়াবুল ঈমান, হাদীস-৩৬০১, সুনানে তিরমিযী, হাদীস-৬৮২,সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস-১৬৪২ মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস-১৫৭২ মুসান্নাফে ইবনে আবীশাইবা, হাদীস-৮৯৬০

 

৫. জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভের মাস এবং দুআ কবুলের মাস

পূর্বের হাদীসেই বর্ণিত হয়েছে, আল্লাহ তাআলা এ মাসের প্রতি রাত্রে অসংখ্য জাহান্নামীকে মুক্তি দানকরেন। সুতরাং আমাদের কর্তব্য, বেশি বেশি নেক আমল এবং তাওবা-ইস্তিগফারের মাধ্যমে নিজেদেরকে এই শাহী ফরমানের অন্তর্ভুক্ত করা।

এ প্রসঙ্গে অন্য হাদীসে হযরত জাবির রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়াসাল্লাম বলেছেন-

إن لله عند كل فطر عتقاء، وذلك في كل ليلة.

وقال البوصيري : رجال إسناده ثقات

অবশ্যই আল্লাহ তাআলা রমযান মাসে প্রতি ইফতারের সময় অসংখ্য ব্যক্তিকে জাহান্নাম থেকে মুক্তিদান করেন। প্রতি রাতেই তা হয়ে থাকে।-সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস-১৬৪৩, মুসনাদে আহমদ,হাদীস-২২২০২, তবারানী হাদীস-৮০৮৮. বায়হাকী-৩৬০৫

হযরত আবু হুরায়রা রা. অথবা আবু সাঈদ খুদরী রা. বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

إن لله عتقاء في كل يوم وليلة (يعني في رمضان) لكل عبد منهم دعوة مستجابة.

قال الشيخ شعيب الارنؤوط : وإسناده صحيح على شرط الشيخين.

অবশ্যই আল্লাহ তাআলা রমযান মাসের প্রত্যেক দিবস ও রাত্রিতে অসংখ্য ব্যক্তিকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দান করেন। এবং প্রত্যেক মুমিন বান্দার একটি করে দুআ কবুল করেন। -মুসনাদে আহমদহাদীস ৭৪৫০, মুসনাদে বাযযার, হাদীস-৯৬২

হযরত জাবির রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

إن لله في كل يوم وليلة عتقاء من النار في شهر رمضان، وإن لكل مسلم دعوة يدعو بها فيستجاب له.

وقال الهيثمى فى المجمع : رواه البزار، ورجاله ثقات.

রমযান মাসের প্রতিটি দিবস ও রজনীতে আল্লাহ তাআলা অসংখ্য ব্যক্তিকে জাহান্নাম থেকে মুক্তিদান করেন। প্রত্যেক মুসলিমের একটি দুআ, যা সে করে, কবুল করা হয়।-মুসনাদে বায্যার, হাদীস৩১৪১, মাযমাউয যাওয়াইদ, ১৭২১৫

 

৬. দানশীলতার মাস

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা. বলেন,

كان رسول الله صلى الله عيله وسلم أجود الناس، وكان أجود ما يكون في رمضان، حين يلقاه جبريل، وكانيلقاه في كل ليلة من رمضان فيدارسه القرآن، فلرسول الله صلى الله عليه وسلم أجود بالخير من الريح المرسلة.

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন মানুষের মাঝে সর্বশ্রেষ্ঠ দাতা। তাঁর দানশীলতা(অন্য সময় হতে) অধিকতর বৃদ্ধি পেত রমযান মাসে, যখন জিব্রীল আ. তার সাথে সাক্ষাৎকরতেন। জিব্রীল আ. রমযানের প্রতি রাত্রে আগমন করতেন এবং তাঁরা পরস্পর কুরআনশুনাতেন। তো আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন কল্যাণবাহী বায়ুর চেয়েওঅধিক দানশীল।-সহীহ বুখারী, হাদীস-৬, সহীহ মুসলিম হাদীস-২৩০৮, মুসনাদে আহমদ, ২৬১৬

হযরত যায়েদ ইবনে খালেদ আলজুহানী রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

من فطر صائما كان له مثل أجره، غير أنه لا ينقص من أجر الصائم شيئًا.

قال الترمذى : هذا حديث حسن صحيح.

যে ব্যক্তি কোনো রোযাদারকে ইফতার করাবে, সে তার (রোযাদারের) অনুরূপ প্রতিদান লাভকরবে। তবে রোযাদারের প্রতিদান হতে বিন্দুমাত্রও হ্রাস করা হবে না।-সুনানে তিরমিযী,হাদীস-৮০৭, মুসনাদে আহমদ, হাদীস-১৭০৩৩, সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস-১৭৪৬, সহীহ ইবনেহিববান, হাদীস-৩৪২৯, সহীহ ইবনে খুযাইমা, হাদীস-২০৬৪

হযরত আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন-

من فطر صائما أطعمه وسقاه كان له مثل أجره.

رواه عبد الرزاق في مصنفه : وهو في حكم المرفوع، فمثله لا يعرف بالرأي،

যে ব্যক্তি কোনো রোযাদারকে পানাহার করিয়ে ইফতার করাবে, সে তার অনুরূপ সওয়াব লাভ করবে। -মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক হাদীস-৭৯০৬

৭. আমলের সওয়াব বহুগুণ বৃদ্ধির মাস

রমযান মাসের আরেকটি বৈশিষ্ট্য এই যে, এ মাস মুমিনের নেক আমলের প্রতিদান বৃদ্ধির মাস এবংআখেরাতের সওদা করার শ্রেষ্ঠ সময়। দুনিয়ার ব্যবসায়ীদের যেমন বিশেষ বিশেষ মৌসুম থাকে,যখন খুব জমজমাট ব্যবসা হয় এবং বছরের অন্য সময়ের তুলনায় আয়-উপার্জন ও মুনাফা বেশিহয়, তেমনি আখেরাতের ব্যবসায়ীদের জন্য ব্যবসার শ্রেষ্ঠ মওসুম হচ্ছে রমযান মাস। এ মাসেআমলের দ্বারা অনেক বেশি মুনাফা লাভ করা যায়।

এ প্রসঙ্গে হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে-

عن ابن عباس رضي الله عنه قال : قال رسول الله صلى الله عليه وسلم لامرأة من الأنصار، سماها ابنعباس فنسيت اسمها (وفي الرواية الأخرى : يقال لها أم سنان)، ما منعك أن تحجي معنا؟ قالت : لم يكن لنا إلاناضحان، فحج أبو ولدها وابنها على ناضح وترك لنا ناضحا ننضح عليه، قال : إذا جاء رمضان فاعتمري، فإنعمرة فيه تعدل حجة.

وفي رواية أخرى لمسلم : فعمرة في رمضان تقضي حجة أو حجة معي.

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক আনসারী মহিলাকে বললেন, বর্ণনাকারী বলেন, তার নাম ইবনে আববাস রা. উল্লেখ করেছিলেনকিন্তু আমি তা ভুলে গিয়েছি-(অন্য বর্ণনায় তার নাম উম্মে সিনান উল্লেখ করা হয়েছে) তুমি কেন আমাদের সাথে হজ্ব করতে যাওনি? তিনি বললেন, আমাদের পানি বহনকারী দুটি মাত্র উট রয়েছে।একটিতে আমার ছেলের বাবা (স্বামী) ও তাঁর ছেলে হজ্ব করতে গিয়েছেন, অন্যটি পানি বহনের জন্য আমাদের কাছে রেখে গিয়েছেন। তিনি বলেন, রমযান মাস এলে তুমি উমরা করবে। কেননা এমাসের উমরা একটি হজ্বের সমতুল্য। সহীহ মুসলিমের অন্য বর্ণনায় আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহুআলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, রমযান মাসের উমরা একটি হজ্বের সমতুল্য। অথবা বলেছেন, আমার সাথে একটি হজ্বের সমতুল্য (সওয়াবের হিসাবে)।-সহীহ বুখারী, হাদীস, ১৭৮২,সহীহ মুসলিম-১২৫৬, মুসনাদে আহমদ, হাদীস-২০২৫

হযরত উম্মে মাকিল রা. হতে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

عمرة في رمضان تعدل حجة.

رواه الترمذي في سننه، وقال : حديث أم معقل حديث حسن غريب، ورواه أبو داود، وفي رواية أحمد عن أممعقل الأسدية، أنها قالت : يا رسول الله صلى الله عليه وسلم! إني أريد الحج وجملي أَعْجَفُ، فما تأمرني، قال :اعتمري في رمضان، فإن عمرة في رمضان تعدل حجة.

রমযান মাসে উমরা হজ্বের সমতুল্য। -সুনানে তিরমিযী, হাদীস-৯৩৯, সুনানে আবু দাউদ, হাদীস১৯৮৬।

অন্য বর্ণনায় রয়েছে, উম্মে মাকিল রা. বলেন-ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি তো হজ্ব করতে ইচ্ছুক। কিন্তুআমার উটটি দুর্বল। তিনি বললেন, তুমি রমযান মাসে উমরা করো। কেননা রমযান মাসে উমরা(সওয়াব হিসেবে) হজ্বের সমতুল্য। মুসনাদে আহমদ, হাদীস ২৭২৮৫

৮. পাপ মোচন ও গুনাহ থেকে ক্ষমা লাভের মাস

হযরত আবু হুরায়রা রা. বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতেন-

الصلوات الخمس والجمعة إلى الجمعة ورمضان إلى رمضان مكفرات ما بينهن، إذا اجتنب الكبائر.

পাঁচ ওয়াক্ত নামায, এক জুমুআ থেকে আরেক জুমুআ এবং এক রমযান থেকে আরেক রমযান মধ্যবর্তী সময়ের গুনাহসমূহকে মুছে দেয় যদি সে কবীরা গুনাহ থেকে বেঁচে থাকে।-সহীহ মুসলিম,হাদীস ২৩৩ (৩)

পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, রমযান মাস হল মাগফিরাত লাভের মাস, যে মাসে সকলের জন্যক্ষমার দুয়ার উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। ক্ষমা লাভের এমন সূবর্ণ সুযোগ পেয়ে যে ব্যক্তি নিজের পাপসমূহ ক্ষমা করাতে পারে না সে সত্যিই ক্ষতিগ্রস্ত। হাদীস শরীফে তার জন্য বদ দুআ করাহয়েছে।

হযরত কা’ব ইবনে উজরা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন-

قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : احضروا المنبر، فحضرنا، فلما ارتقى درجة قال آمين، فلما ارتقىالدرجة الثانية قال آمين، فلما ارتقى الدرجة الثالثة قال آمين، فلما نزل، قلنا : يا رسول الله! لقد سمعنا منك اليومما كنا نسمعه، قال : إن جبريل عرض لي فقال : بعد من أدرك رمضان فلم يغفر له، قلت : أمين، فلما رقيتالثانية، قال : بعد من ذكرت عنده فلم يصل عليك، قلت : آمين، فلما رقيت الثالثة، قال : بعد من أدرك أبويهالكبير أو أحدهما فلم يدخلا الجنة، قلت : آمين.

رواه الحاكم، وقال : صحيح الإسناد، واورده الهيثمى فى المجمع وقال : رواه الطبرانى ورجاله ثقات.

একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে বললেন, তোমরা মিম্বরের নিকটসমবেত হও। আমরা সকলেই তথায় উপস্থিত হলাম। যখন তিনি মিম্বরের প্রথম সিড়িতে পারাখলেন, তখন বললেন, আমীন, যখন দ্বিতীয় সিঁড়িতে পা রাখলেন বললেন, আমীন, যখন তিনিতৃতীয় সিঁড়িতে পা রাখলেন বললেন, আমীন।

 

রোজাদারদের জন্য জরুরী মাসায়েল

প্রশ্নঃ চোখে ড্রপ ব্যবহারে রোযা ভেঙে যাবে?

উত্তরঃ রোজা অবস্থায় চোখে ড্রপ, সুরমা, মলম বা অন্য যে কোনো ঔষধ ব্যবহার করা যাবে। এতে রোজা ভঙ্গ হবে না- যদিও তার স্বাদ গলায় অনুভব হয়। ফতোয়ায়ে শামি: ২/১০৬, ফতোয়ায়ে আলমগিরি: ১/২০৩, হেদায়া: ২/২১৭

প্রশ্নঃ রোজা অবস্থায় স্যালাইন দেয়া যাবে কি?

উত্তরঃ রোজা অবস্থায়ও স্যালাইন ব্যবহার করা যাবে। কারণ, স্যালাইন দেয়া হয় রগে। আর রগের মাধ্যমে কোন কিছু দেহে প্রবেশ করলে রোজা ভাঙবে না। তাই রোজা রেখেও স্যালাইন দেয়া যাবে। এতে রোজার কোন অসুবিধা হবে না। তবে, রোজা জনিত দূর্বলতা রোধ করার জন্য স্যালাইন ব্যবহার করা যাবে না। এমনটি করা মাকরুহ। বরং রোজা জনিত দুর্বলতার উপর ধৈর্য ধারন করতে হবে।

প্রশ্নঃ নাকে ড্রপ ব্যবহারে রোযা ভেঙে যাবে?

উত্তরঃ রোজা অবস্থায় নাকে ড্রপ বা অন্য যে কোনো তরল ঔষধ ব্যবহার করা যাবে না। করলে রোজা ভেঙ্গে যাবে।

ফতোয়ায়ে শামি: ২/১১০, ফতোয়ায়ে আলমগিরি: ১/২০৪

প্রশ্নঃ কানে ড্রপ ব্যবহারে রোযা ভেঙে যাবে?

উত্তরঃ যদি কেউ তার কানে তেল, ড্রপ বা অন্য কোনো তরল ঔষধ ইত্যাদি প্রবেশ করায় তাহলে তার রোজা ভাঙবে না। মাকালাতু মাজমাইল ফিকহ: ১০ খণ্ড, ২/৪৪৪, আল মওসুয়াতুত তিব্বীয়া: ৬২৪

প্রশ্নঃ ইনজেকশন নেয়ার দ্বারা রোযা ভেঙে যাবে?

উত্তরঃ শারীরিক শক্তি বৃদ্ধি ছাড়া অন্য যে কোনো কারণে ইনজেকশন নিলে রোজা নষ্ট হবে না। চাই তা মাংসে নেয়া হোক বা রগে।

কারণ ইনজেকশনের সাহায্যে দেহের অভ্যন্তরে প্রবেশকৃত ওষুধ মাংস বা রগের মাধ্যমেই প্রবেশ করানো হয়ে থাকে, যা অস্বাভাবিক প্রবেশপথ, তাই এটি রোজা ভঙ্গের গ্রহণযোগ্য কারণ নয়। ইনসুলিন নিলেও রোজা ভাঙবে না। কারণ ইনসুলিন রোজা ভঙ্গ হওয়ার গ্রহণযোগ্য রাস্তা দিয়ে প্রবেশ করে না এবং গ্রহণযোগ্য খালি জায়গায়ও প্রবেশ করে না।

প্রশ্নঃ রোজা রাখা অবস্থায় রক্ত দিলে রোজা ভাঙবে?

উত্তরঃ রোজা রাখা অবস্থায় রক্ত দিলে রোজা ভাঙবে না। তবে কেউ যদি শারীরিকভাবে এমন দুর্বল হয় যে, রক্ত দিলে সে রোজা রাখার শক্তি হারিয়ে ফেলবে- তাহলে তার জন্য রক্ত দেওয়া মাকরুহ। -আহসানুল ফাতাওয়া: ৪/৪৩৫

আর রক্ত নিলে যেহেতু এ রক্ত শরীরের উল্লেখযোগ্য চার নালি থেকে কোনো নালি দিয়ে প্রবেশ করে না, বরং শরীরের অন্যান্য ছোট ছিদ্রের মাধ্যমে প্রবেশ করে। সুতরাং রোজাবস্থায় কারও শরীরে রক্ত দান করলে বা নিজে রক্ত গ্রহণ করলে রোজা নষ্ট হবে না।

প্রশ্নঃ ইনহেলার ব্যবহার করলে কি রোজা ভেঙে যায়?

উত্তরঃ শ্বাসকষ্ট দূর করার জন্য মুখের ভেতরে ইনহেলার স্প্রে করা হয়। এতে যে জায়গায় শ্বাসরুদ্ধ হয় জায়গাটি প্রশস্ত হয়ে যায়। ফলে শ্বাস চলাচলে আর কষ্ট থাকে না।

ওষুধটি যদিও স্প্রে করার সময় গ্যাসের মতো দেখা যায়। কিন্তু বাস্তবিক পক্ষে তা দেহবিশিষ্ট তরল ওষুধ। অতএব মুখের অভ্যন্তরে ইনহেলার স্প্রে করার দ্বারা রোজা ভেঙে যাবে।

তবে মুখে স্প্রে করার পর না গিলে যদি থুতু দিয়ে ফেলে দেয়া হয়, তা হলে রোজা ভঙ্গ হবে না। এভাবে কাজ চললে বিষয়টি অতিসহজ হয়ে যাবে। এতে শ্বাসকষ্ট থেকে রেহাই পাওয়ার পাশাপাশি রোজা ভঙ্গ হবে না।

রোজা অবস্থায় ইনহেলার ব্যবহারের নিয়ম

কোনো কোনো চিকিৎসক বলেন, সেহরিতে এক ডোজ ইনহেলার নেয়ার পর সাধারণত ইফতার পর্যন্ত আর ইনহেলার ব্যবহারের প্রয়োজন পড়ে না। তাই এভাবে ইনহেলার ব্যবহার করে রোজা রাখতে হবে।

তবে কারও অবস্থা যদি এমন মারাত্মক আকার ধারণ করে যে, ইনহেলার নেয়া ব্যতীত ইফতার পর্যন্ত অপেক্ষা করা কষ্টকর হয়ে পড়ে, তা হলে তাদের ক্ষেত্রে শরিয়তে এ সুযোগ রয়েছে যে, তারা প্রয়োজনভেদে ইনহেলার ব্যবহার করবে এবং পরবর্তী সময় রোজা কাজা করে নেবে।

আর কাজা করা সম্ভব না হলে ফিদিয়া আদায় করবে। আর যদি ইনহেলারের বিকল্প কোনো ইনজেকশন থাকে, তা হলে তখন ইনজেকশনের মাধ্যমে চিকিৎসা করবে। কেননা রোজা অবস্থায় ইনজেকশন নিলে রোজা ভাঙবে না

 

রোযার কাযা কাফফারা ও ফিদয়া প্রসংঙ্গঃ

রমজান মাসে যারা অসুস্থ বা পীড়িত, অতিশয় বৃদ্ধ, যাদের দৈহিক ভীষণ দুর্বলতার কারণে রোজা পালন করা খুবই কষ্টদায়ক হয় এবং যারা ভ্রমণে থাকার কারণে সিয়াম পালন করতে পারে না, তাদের জন্য রোজার কাজা, কাফফারা ও ফিদ্ইয়া ইত্যাদি বদলা ব্যবস্থা স্থির করে ইসলামি শরিয়তে সুনির্দিষ্ট বিধি-বিধান রয়েছে।

এ সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কোরআনুল কারীমে ঘোষণা করেছেন৷

ﻓﻤﻦ ﻛﺎﻥ ﻣﺮﻳﻀﺎ ﺍﻭﻋﻠﻲ ﺳﻔﺮ ﻓﻌﺪﺓ ﻣﻦ ﺍﻳﺎﻡ ﺍﺧﺮ.

অর্থ:- আর যে ব্যক্তি অসুস্হ কিংবা মুসাফির অবস্তায় থাকবে, সে অন্য দিনে গণনা পূরণ করবে। অর্থাৎ (যে রোযাগুলো রাখতে পারে নাই, তা পরেপূর্ণ করবে।)

(ﺳﻮﺭﺓ ﺍﻟﺒﻘﺮﺓ আয়াত ১৮)

রোজার কাজা-কাফফারার মাসাঈলঃ

রোযার কাফফারা কি?

রোযার কাফ্ফারা হলঃ

একটি গোলাম আযাদ করা। আর তা সম্ভব না হলে, ৬০টি রোযা (একটি কাযা বাদেও) এই ৬০টি রোযা একাধারে রাখতে হবে। মাঝখানে ছুটে গেলে আবার পুণরায় পূর্ণ ৬০টি একাধারে রাখতে হবে। এই ৬০ দিনের মধ্যে নেফাস বা রমযানের মাস এসে যাওয়ার কারণে বিরতি হলেও কাফ্ফরা আদায় হবে না। বিরতিহীনভাবে ৬০টি রোযা রাখার সামর্থ না থাকলে পূর্ণ খোরাক খেতে পারে- এমন ৬০জন মিসকীনকে অথবা এক জনকে ৬০দিন দু’বেলা পরিতৃপ্তির সাথে খাওয়াতে হবে অথবা সদকায়ে ফিতরয়ে যে পরিমাণ গম বা তার মূল্য দেয়া হয়, প্রত্যেককে সে পরিমাণ দিতে হবে। এই গম ইত্যদি বা মূল্য দেয়ার ক্ষেত্রে এক জনকে ৬০ দিনেরটা এক দিনেই দিয়ে দিলে কাফ্ফারা আদায় হবে না। তাতে মাত্র এক দিনের কাফ্ফারা ধরা হবে।

(ফাতওয়ায়ে আলমগীরী, রদ্দুল মুহতার, আল-বাহরুর রায়েক)

  1. মাসয়ালা:-

কোনো সুস্থ বালেগ মুসলমান ইচ্ছাকৃত রমজানের রোজা না রাখলে বা অনিচ্ছায় ভেঙে ফেললে অথবা কোনো ওজরের কারণে ভেঙে ফেললে পরে ওই রোজার কাজা আদায় করতে হবে। আর বিনা ওজরে ইচ্ছাকৃত পানাহার বা সহবাসের মাধ্যমে রমজানের রোজা ভেঙে ফেললে, তার কাজা ও কাফফারা (অর্থাৎ লাগাতার ষাট দিন রোজা রাখতে হবে।) পানাহার ও সহবাস ছাড়া অন্য পদ্ধতিতে ইচ্ছাকৃত ভাঙলেও কাফফারা দিতে হবে না। হ্যাঁ, কাজা দিতে হবে।

(আল মাবসুতে সারাখসি- ৩/৭২)

  1. মাসয়ালা:-

কাফফারা আদায়ের ক্ষেত্রে লাগাতার ষাট দিন রোজা রাখার সময় যদি এক দিনও বাদ যায়। তাহলে আবার শুরু থেকে গণনা আরম্ভ হবে, পূর্বেরগুলো বাদ হয়ে যাবে।

(ﺍﻟﻤﺒﺴﻮﺕ ﻟﻠﺴﺮﺧﻲ আল মাবসুতে সারাখসি: ৩/৮২)

.

  1. মাসয়ালা:-

মুসাফির ও অসুস্থ ব্যক্তি রোজা রাখতে কষ্ট হলে ওই দিন না রেখে পরে কাজা করে নিতে পারবে, এ ক্ষেত্রে কাফফারা দিতে হবে না।

(সূরা বাকারা: ১৮৪-১৮৫)

  1. মাসয়ালা:-

মাসিক পিরিয়ড ও সন্তান প্রসবোত্তর স্রাবের সময় রোজা রাখা জায়েয নেই। তবে সে দিনগুলোর রোজার কাজা দিতে হবে, কাফফারা দিতে হবে না।

  1. মাসয়ালা:-

রোজা রাখার পর দিনের বেলায় যদি কোনো নারীর পিরিয়ড শুরু হয়। তখন ওই নারীর জন্য খাওয়া-দাওয়ার অনুমতি আছে। তবে লোকজনের সামনে না খেয়ে নির্জনে খাওয়া-দাওয়া করবে। আর যে মহিলা পিরিয়ডের কারণে রোজা রাখেনি, দিনের যে সময়ে তার রক্ত বন্ধ হবে, তখন থেকেই খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে, রোজাদারের ন্যায় দিনের অবশিষ্ট অংশটুকু অতিবাহিত করবে এবং পরবর্তীতে উভয়েই ওই দিনের রোজা কাজা করে নিবে।

(ﺍﻟﻠﺒﺎﺏ আল লুবাব: ১/১৭৩)

.

  1. মাসয়ালা:-

রোজার জন্য নারীদের ঔষধ খেয়ে পিরিয়ড সাময়িক বন্ধ রাখা অনুচিত। এতে শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তবে এ পদ্ধতিতে পিরিয়ড বন্ধ থাকা অবস্থায় রোজা-নামাজ করলে তা আদায় হয়ে যাবে।

(ফাতাওয়ায়ে রহিমিয়া: ৬/৪০৪, আপকে মাসায়েল আওর উনকা হল: ৩/২৭৮)

রোযার ফিদইয়া কি?

ফিদইয়া অর্থ ক্ষতিপূরণ। রোযা রাখতে না পারলে বা কাযা আদায় করতে না পারলে যে ক্ষতিপূরণ দিতে হয়, তাকে ফিদইয়া বলে। এক রোযার পরিবর্তে এক ফিদইয়া ফরজ হয়। এক ফিদইয়া হল- সাদকায়ে ফিতরার সমপরিমাণ। অর্থাৎ- পৌনে দুই কেজি গম বা তার মূল্য অথবা সে মূল্যের সমপরিমাণ কোন দ্রব্য কোন মিসকীনকে দান করা অথবা কোন মিসকিনকে দু’বেলা পেট ভরে খাওয়ানো।

(দেখুনঃ ﻓﺘﺢ ﺍﻟﻘﺪﻳﺮ ফাতহুল কাদীর)

যে সকল কারণে ফিদইয়া দিতে হয়।

  1. মাসয়ালা:-

যদি কোনো ব্যক্তি অসুস্থতার কারণে অভিজ্ঞ মুসলিম ডাক্তারের পরামর্শে রোজা রাখা থেকে বিরত থাকেন এবং পরবর্তীতে সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে তাহলে সুস্থ হওয়ার পর রোজার কাজা আদায় করতে হবে, ফিদইয়া দিলে আদায় হবে না।

পক্ষান্তরে যদি আরোগ্য হওয়ার সম্ভাবনা না থাকে বা এমন বৃদ্ধ যে রোজা রাখতে অক্ষম, তাহলে সে ফিদইয়া আদায় করবে। রোজা রাখতে অক্ষম বলতে শরিয়তের দৃষ্টিতে বার্ধক্যজনিত দুর্বলতা, মারাত্মক রোগ ইত্যাদি বোঝায়, যা থেকে আরোগ্য লাভ করা এবং রোজা রাখার শক্তি ফিরে পাওয়া অসম্ভব বলে মনে হয়।

( ﺳﻮﺭﺓ ﺍﻟﺒﻘﺮﺓ সূরা বাকারা: ১৮৪-১৮৫)

  1. মাসয়ালা:-

প্রত্যেক রোজার ফিদইয়া হলো, সদকা ফিতরের সমপরিমাণ। অর্থাৎ ১ কেজি ৬৩৫ গ্রামের কিছু বেশি গম বা তার সমপরিমাণ অর্থ।

(ﺍﻭﺯﺍﻥ ﺷﺮﻋﻴﺔ – আওযানে শরইয়্যাহ )

  1. মাসয়ালা:-

শারীরিক সুস্থতা ফিরে আসলে এবং রোজার কাজার ওপর সক্ষম হলে, অতীতের রোজা কাজা করতে হবে।

(ﺍﻟﺮﺩ ﺍﻟﻤﺤﺘﺎﺭ রদ্দুল মুহতার: ২/৪২৭)

  1. মাসয়ালা:-

ফিদইয়া আদায়ের ক্ষেত্রে ধনী-গরীবের মাঝে কোনো তারতম্য নেই, সবার ওপর সমানহারে প্রযোজ্য। তবে দারিদ্রতার দরুন ফিদইয়া দিতে একেবারেই অক্ষম হলে, তওবা করবে। পরবর্তীতে কখনও সামর্থ্যবান হলে, অবশ্যই ফিদইয়া আদায় করে দিবে।

(ﻓﺘﻮﺓ ﺍﻟﻬﻨﺪﻱ- ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া ১/৫১৩)

  1. মাসয়ালা:-

৬০ মিসকিনকে দু’বেলা খানা খাওয়ানোর পরিবর্তে প্রত্যেককে এক ফিতরা পরিমাণ- অর্থাৎ ১ কেজি ৬৩৫ গ্রামের কিছু বেশি গম বা তার সমপরিমাণ অর্থ দেওয়া যেতে পারে। তবে শর্ত হলো, ওই টাকা দ্বারা মিসকিনকে খানা খাওয়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে। একজন গরিবকে প্রতিদিন ১ ফিতরা পরিমাণ করে ৬০ দিনে দিলেও আদায় হবে। ৬০ দিনের ফিতরা পরিমাণ একত্রে বা এক দিনে দিলে আদায় হবে না।

(ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া: ১/৫১৩, রদ্দুল মুহতার: ৩/৪৭৮)

ইচ্ছাকৃত রোজা ভঙের কাফফারাঃ

  1. মাসয়ালা:-

কোনো ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে একাধিকবার একই রমজানের রোজা ভাঙার কারণে এক কাফফারাই যথেষ্ট। অর্থাৎ ভেঙে ফেলা সব রোজার জন্য ৬০ জন মিসকিনকে দু’বেলা খানা খাওয়াবে, অথবা প্রতি মিসকিনকে এক ফিতরা পরিমাণ সম্পদ সদকার মাধ্যমেও কাফফারা আদায় করা যাবে।

(বাদায়েউস সানায়ে: ২/১০১, রদ্দুল মুহতার: ২/৪১৩)

  1. মাসয়ালা:-

মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে তার কাজাকৃত রোজার কাফফারা হিসেবে অন্য কারো রোজা রাখার বিধান নেই। তবে মৃত্যুকালে সে ব্যক্তি ফিদইয়া প্রদানের অসিয়ত করলে- (যা পূর্ণ করা ওয়াজিব) তার রেখে যাওয়া সম্পদের এক তৃতীয়াদংশ মাল থেকে অসিয়ত পূর্ণ করা জরুরি। অসিয়ত না করলে ফিদইয়া দেয়া জরুরি নয়। তবে বালেগ ওয়ারিসরা নিজ নিজ অংশ হতে তা আদায় করলে, আদায় হওয়ার আশা করা যায়।

(1): ﺍﻟﺠﻮﻩﺭﺓ ﺍﻟﻨﻴﺮﺓ ১/১৪৩, ২/৪২৪ ﺍﻟﺪﺭ ﺍﻟﻤﺨﺘﺎﺭ)

  1. মাসয়ালা:-

(1) বিড়ি, সিগারেট, হুক্কা পান করলে, রোজা ভেঙ্গে যাবে।

(2) রোজা রেখে দিনেরবেলা স্ত্রীসহবাস করলে। বীর্যপাত না হলেও উভয়ের

রোজা ভেঙ্গে যাবে।

(3) রোজা রেখে ইচ্ছাকৃত পানাহার করলে ভেঙ্গে যাবে।

উপরের সবগুলো কারণে কাজা ও কাফফারা দুটিই ওয়াজিব হবে।

কাজা ও কাফ্ফারাঃ

কাজা মানে- পরবর্তীতে একটি রোজা রাখতে হবে।

আর কাফফারা মানে ধারাবাহিকভাবে 60 টি রোজা রাখতে হবে। ধারাবাহিকতা নষ্ট হলে নতুন করে আবার শুরু করতে হবে। (মহিলাদের পিরিয়ডের কারণে ধারাবাহিকতা নষ্ট হলে সমস্যা নেই।

 

 মাহে রমযানে আমাদের করনীয় ও বর্জনীয় কাজসমূহ

আরবী মাস সমূহের শ্রেষ্ঠ মাস হলো, পবিত্র রমযান মাস । এ মাস কল্যাণময় মাস, কুরআন নাযিলের মাস, রহমত বরকত ও মাগফিরাত এবং নাজাতের মাস । এ মাস তাকওয়া ও সংযম প্রশিক্ষণের মাস, সবর ও ধর্য্যের মাস। এ মাস জীবনকে সমস্ত পাপ পংকিলতা থেকে মুক্ত করে মহান আল্লার রেজামন্দি ও নৈকট্য লাভের মাস ।

ইরশাদ হয়েছে,“রমযান মাস, এ মাসে মানুষের দিশারী এবং সৎপথের স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারীরূপে কুরআন নাযিল হয়েছে । সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা এ মাস পাবে তারা যেন এ মাসে সিয়াম তথা রোযা পালন করে ।” ( সূরা বাকারা : আয়াত ১৮৫ )

 

রমযানের বৈশিষ্ট্য

রমযানের বৈশিষ্ট্য অনেক । নিম্নে কিছু বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হলো ;

১. আল্লাহ তা’আলা প্রত্যহ জান্নাতকে সুসজ্জিত করে বলেন, অনতিবিলম্বে আমার নেক বান্দারা দুনিয়াবী বিপদ- মুসিবত এড়িয়ে তোমার মাঝে এসে পৌঁছবে ।

২. রমযান মাসে শয়তানকে সিকলে বেঁধে রাখা হয় ।

৩. রমযান মাসে জান্নাতের দরজা খুলে দেয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজা বন্ধ করে রাখা হয় ।

৪. রমযান মাসে একটি বরকতময় রাত আছে যা হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ । আর তা হলো- লাইলাতুল কদর ।

৫. রমযানের শেষ রাতে সমস্ত রোযাদারদেরকে ক্ষমা করে দেয়া হয় ।

৬. রমযানের প্রতি রাতে জাহান্নাম থেকে অনেক লোককে মুক্তি দেয়া হয় ।

৭. রমযানে বান্দার নেকী দশ হতে সাতশতগুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করে দেয়া হয় ।

যাদের উপর রোযা রাখা ফরজ

যাদের মাঝে নিম্নের শর্তাবলী পাওয়া যাবে , তার উপর রমযান মাসের রোযা যথা সময়ে আদায় করা এবং যথা সময়ে আদায় করতে না পারলে কাযা আদায় করা ফরয।

১. বালেগ হওয়া । সুতরাং নাবালেগের উপর রোযা ফরজ নয় ।

২. মুসলমান হওয়া । সুতরাং কাফিরের উপর রোযা ফরজ নয় ।

৩. জ্ঞানসম্পন্ন হওয়া । সুতরাং পাগলের উপর রোযা ফরজ নয় ।

৪. দারুল ইসলামের অধিবাসী হওয়া অথবা দারুল হরবে থাকলেও রোযা ফরজ হওয়ার ব্যাপারে জ্ঞাত থাকা ।

৫. মুকীম হওয়া । সুতরাং মুসাফিরের জন্য রোযা রাখা ফরজ নয় ।

৬. সুস্থ থাকা । সুতরাং অসুস্থ ব্যক্তির জন্য রোযা রাখা ফরজ নয় ।

৭. মহিলারা হায়েয নেফাস থেকে মুক্ত থাকা ।

রোযার নিয়ত

নিয়ত ব্যতীত রোযা হয় না । নিয়তের স্থল হলো অন্তর । রাত থেকে শুরু করে (শরীয়তগ্রাহ্য) দিনের অর্ধেক অংশের পূর্ব পর্যন্ত ( অর্থাৎ সুবহে সাদেক ও সূর্যাস্তের ঠিক মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত , যা সূর্য মধ্যগগণে স্থির হওয়ার ৪০/৪৫ মিনিট পূর্বে হয় ) রোযার নিয়ত করা শুদ্ধ ।

 

রোযাদারের জন্য যেসব কাজ করা মাকরুহ নয়

রোযাদারের জন্য নিম্নের কাজগুলো করা মাকরুহ নয় ।

১. গোঁফে ও দাড়িতে তেল লাগানো ।

২. সুরমা লাগানো ।

৩. শীতলতা লাভের উদ্দেশ্যে গোসল করা ।

৪. শীতলতা লাভের উদ্দেশ্যে ভেজা কাপড় গায়ে জড়ানো ।

৫. রোযা রেখে দিনের শেষভাগে মিসওয়াক করা সুন্নত, যেমন প্রথমভাগে করা সুন্নত ।

 

মুস্তাহাব কাজসমূহ

১. সময় মত সাহরী খাওয়া । সাহরীর সময়ের শেষ ভাগে খাওয়া ।

২. সূর্যাস্তের পর বিলম্ব না করে ইফতার করা ।

৩. রাতে বড় নাপাকি হলে ফজরের পূর্বেই গোসল করে পাক হওয়া ।

৪. গীবত, পরনিন্দা ও গালি-গালাজ থেকে জিহবাকে সংযত রাখা ।

৫. রমযানের সূবর্ণ সুযোগকে যথাযথভাবে কাজে লাগানো, অর্থাৎ কুরআন তেলাওয়াত , যিকির, ইত্যাদিতে লিপ্ত থাকা,উত্তেজিত না হওয়া ।

৬. যথাসম্ভব এ মাসের রাতে ( বৈধ হলেও ) সহবাস হতে নিজেকে বিরত রাখা ।

৭. ক্রোধান্বিত না হওয়া এবং তুচ্ছ কোন বিষয় নিয়ে উত্তেজিত না হওয়া ।

 

যেসব কারণে রোযা ভাঙ্গে না এবং মাকরুহ হয় না

১. মেসওয়াক করা ।

২. শরীর, মাথা, দাড়ি এবং গোঁফে তেল লাগানো ।

৩. চোখে সুরমা বা ঔষধ লাগানো ।

৪. খুশবু লাগানো বা তার গ্রাণ নেয়া ।

৫. ভুলে কিছু পান করা ,আহার করা এবং স্ত্রী সহবাস করা ।

৬. গরম বা পিপাশার কারণে গোসল করা বা বারবার কুলি করা ।

৭. অনিচ্ছাবশত: গলায়র মধ্যে ধোঁয়া, ধুলা-বালি-মাছি ইত্যাদি প্রবেশ করা ।

৮. কানে অনিচ্ছাবশত পানি চলে যাওয়ার কারণে রোযা ভঙ্গ হয় না । তবে ইচ্ছাকৃতভাবে দিলে সতর্কতা হলো সে রোযাটি কাযা করে নেয়া ।

৯. অনিচ্ছাকৃত বমি করা ।

১০. স্বপ্ন দোষ হওয়া ।

১১. মুখে থুথু আসলে গিলে ফেলা ।

১২. ইনজেকশন বা টিকা নেয়া ।

১৩. দাঁত উঠালে এবং রক্ত পেটে না গেলে ।

১৪. পাইরিয়া রোগের কারণে অল্প অল্প করে রক্ত বের হলে ।

১৫. সাপ ইত্যাদি দংশন করলে ।

১৬. পান খাওয়ার পর ভালভাবে কুলি করা সত্ত্বেও থুথুর সাথে লালভাব থাকলে ।

১৭. উত্তেজনার সাথে শুধু দৃষ্টিপাত করতেই বীর্যপাত হলে ।

১৮. ইনজেকশনের সাহায্যে শরীর থেকে রক্ত বের করলে ।

 

যেসব কারণে রোযা নষ্ট হয়

১. নাকে ঔষধ প্রবেশ করালে ।

২. ইচ্ছাকৃত মুখ ভরে বমি করলে ।

৩. কুলি করার সময় গলায় পানি চলে গেলে ।

৪. নারী স্পর্শ বা এসংক্রান্ত কোন কারণে বীর্যপাত হলে ।

৫. খাদ্য বা খাদ্য হিসেবে গণ্য এমন কোন বস্তু গিলে ফেললে ।

৬. আগরবাতি ইচ্ছা করে গলা বা নাকের মধ্যে প্রবেশ করালে ।

৭. বিড়ি সিগারেট পান করলে ।

৮. ভুলে খেয়ে ফেলার পর ইচ্ছা করে পুনরায় খাবার খেলে ।

৯. সুবহে সাদেকের পর খাবার খেলে ।

১০. বুঝে হোক বা না বুঝে সূর্য ডুবার আগে ইফতার করলে ।

১১. ইচ্ছা করে স্ত্রী সহবাস করলে ।

 

যেসব কারণে রোযা মাকরূহ হয়

১. বিনা কারণে চিবিয়ে লবণ বা কোন বস্তুর ঘ্রাণ গ্রহণ করা , যেমন টুথপেষ্ট ।

২. গোসল ফরজ অবস্থায় সরাসরি গোসল না করে থাকা ।

৩. শরীরের কোথাও শিঙ্গা ব্যবহার করা বা রক্তপাত করানো ।

৪. পরনিন্দা করা ।

৫. ঝগড়া করা ।

৬. রোযাদার নারী ঠোটে রঙ্গিন জাতীয় কোন বস্তু লাগালে যা মুখের ভেতর চলে যাওয়ার আশংকা রয়েছে ।

৭. রোযা অবস্থায় দাঁত উঠানো বা দাঁতে ঔষধ ব্যবহার করা , তবে একান্ত প্রয়োজনে তা জায়েয ।

সাহরী প্রসঙ্গ

রোযা রাখার নিয়তে শেষ রাতে খাদ্য গ্রহণ করাকে সাহরী বলা হয় । সাহরী খাওয়া সুন্নত । সুবহে সাদেকের একটু পূর্বে সাহরী খাওয়া মুস্তাহাব । রাসূল সা. বলেন-

تسحروا فان فی السحور برڪة

তোমরা সাহরী খাও, এতে অত্যন্ত বরকত নিহীত আছে ” ( মুসলিম শরীফ – ১/৩৫০ )

ইফতার প্রসঙ্গ

সূর্যাস্তের পর পরই ইফতার করা উত্তম । রাসূল সা. বলেন-

لا يزال الناس بخير ما عجلوا الفطر

মানব জাতি ততদিন পর্যন্ত কল্যাণের মধ্যে থাকবে, যতদিন পর্যন্ত তারা ইফতারের সময় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইফতার করে নেবে । (মুসলিম )

খেজুর দিয়ে ইফতার করা সর্বোত্তম । নতুবা অন্তত ইফতারের সূচনা পানি দিয়ে করা উচিত ।

ইফতারের দুআ

ইফতারের বিভিন্ন পর্যায়ে চারটি দুআ রয়েছে –

১. ইফতারী সামনে এলে এই দুআ পড়া –

اللهم لڪ صمت وعلی رزقڪ افطرت وعليڪ توڪلت سبحانڪ و بحمدڪ تقبل منی انڪ انت السميع العليم

২. ইফতরী সামনে রেখে এই দুআ পড়তে থাকা-

يا واسع الفضل اغفرلی

হে বড় দাতা ! আমাকে ক্ষমা করুন ।-

৩. ইফতারের সময় এই দুআ পড়া –

اللهم لڪ صمت وعلی رزقڪ افطرت

হে আল্লাহ ! আমি তোমার জন্য রোযা রেখেছি এবং তোমারই দেয়া রিযিক দ্বারা ইফতার করছি ।’ (আবূ দাউদ )

৪. ইফতার শেষে এই দুআ পড়া –

ذهب الظماء و ابتلت العروق و ثبت الاجر ان شاء الله

পিপাসা নিবারণ হয়েছে, শিরা-উপশিরা সিক্ত হয়েছে, ইনশাআল্লাহ সওয়াবও নির্ধারিত হয়েছে । (আবূ দাউদ )

 

যেসব কারণে রোযা ভেঙ্গে যায় এবং কাযা-কাফ্ফারা উভয় ওয়াজিব হয়

১. রোযা রেখে ইচ্ছাকৃতভাবে পানাহার করলে ।

২. ইচ্ছাকৃত স্ত্রী সহবাস করলে । এতে স্বামী স্ত্রী উবয়ের উপর কাযা ও কাফ্ফারা ওয়াজিব হবে ।

৩. রোযা রেখে পাপ হওয়া সত্ত্বে যদি স্বামী তার স্ত্রীর পায়খানার রাস্তায় পুরুষাঙ্গ প্রবেশ করায় এবং অগ্রভাগ ভেতরে প্রবেশ করে । তাহলে স্বামী স্ত্রী উভয়ের উপর কাযা কাফ্ফারা ওয়াজিব হবে ।

৪. রোযা অবস্থায় কোন বৈধ কাজ করলো, যেমন স্ত্রীকে চুম্বন করল কিংবা মাথায় তেল দিল, তা সত্ত্বেও সে মনে করলো যে, রোযা নষ্ট হয়ে গিয়াছে; আর তাই পরে ইচ্ছাকৃতভাবে পানাহার ইত্যাদি করলো, তাহলে কাযা কাফ্ফারা ওয়াজিব হবে ।

 

রমাদানের শেষ দশকের গুরুত্বপূর্ণ আমল হলো এতেকাফ

পবিত্র লাইলাতুল কদর প্রাপ্তির সুনিশ্চিত প্রত্যাশায় সর্বোপরি মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য রমজানের শেষ দশকের এতেকাফ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ইবাদত।

রমজানের শেষ দশকের এতেকাফ রাসূলুল্লাহ সা:-এর গুরুত্বপূর্ণ একটি সুন্নাত আমল। রমজানের শেষ দশকের এতেকাফ সুন্নতে মোয়াক্কাদা আলাল কেফায়া। অর্থাৎ মহল্লার জামে মসজিদে কোনো রোজাদার মুসলিম এতেকাফ করলে সবার পক্ষ থেকে এ ধরনের সুন্নত আদায় হবে। তাই এলাকাবাসীর কেউ যদি এতেকাফ না করে তাহলে সুন্নত ছেড়ে দেয়ার কারণে সবার সুন্নত তরফের গোনাহ হবে।

এতেকাফ শব্দের শাব্দিক অর্থ হচ্ছে স্থির থাকা, আবদ্ধ থাকা, অবস্থান করা।

শরিয়তের পরিভাষায় নির্ধারিত সময়ে সওয়াব হাসিলের উদ্দেশ্যে পার্থিব ও জাগতিক সব ধরনের সংস্পর্শ ত্যাগ করে মসজিদে অবস্থান করাকে এতেকাফ বলে।

২০ রমজান সূর্যাস্তের কিছুক্ষণ পূর্ব থেকে ২৯ অথবা ৩০ রমজান অর্থাৎ ঈদুল ফিতরের চাঁদ দেখার পূর্ব পর্যন্ত পুরুষদের জন্য মসজিদে এবং নারীদের জন্য নিজ গৃহে নামাজের নির্ধারিত স্থানে নিয়মিত একাধারে অবস্থান করাকে এতেকাফ বলে।

শরিয়তের পরিভাষায় পাঁচ ওয়াক্ত সালাত জামাতসহকারে নিয়মিত আদায় করা হয় এমন মসজিদে মহান আল্লাহর ইবাদতের উদ্দেশ্যে নিয়তসহকারে অবস্থান করাকে এতেকাফ বলে।

এতেকাফের প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে লাইলাতুল কদর প্রাপ্তির মাধ্যমে মহান আল্লাহর একান্ত সান্নিধ্য লাভ।

পবিত্র কুরআনে সূরা বাকারার ১২৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন,‘আমি ইবরাহিম ও ইসমাঈলকে আদেশ দিয়েছিলাম যেন তারা আমার ঘরকে (কাবা) তাওয়াফকারীদের জন্য, এতেকাফকারীদের জন্য ও (সর্বোপরি তার নামে) রুকু-সিজদাহকারীদের জন্য পবিত্র রাখে।

এতেকাফকারী ব্যক্তি এতেকাফ অবস্থায় সকল প্রকার গুনাহ বেচে থাকেন এবং এতেকাফের পুরো সময় জুড়ে তার জন্য নেকী হতে থাতে ।

ফুকাহায়ে কেরামগণ বলেন, এতেকাফকারী ব্যক্তি যদি ফরজ ওয়াজিব এবং সুন্নতে মুআক্কাদা ব্যতিত অন্য কোন এবাদত নাও করেন তাও তিনি এতেকাফের ফজিলত পেয়ে যাবেন।

সহি বুখারীতে আব্দুল্লাহ ইবেন ওমর রা. থেকে একটি হাদীস বর্নিত হয়েছে, তিনি বলেন, নাবীয়ে কারীম সা. রমাদানের শেষ দশকে মসজিদে এতেকাফ করতেন।

সুনানে তিরমিযিতে আম্মাজান আয়েশা সিদ্দিকা রা. থেকে একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, নাবীয়ে কারীম সা. এন্তেকালের আগ পর্যন্ত প্রতি বছর রমাদানের শেষ দশকে এতেকাফ করেছেন।

কোন বর্ণনায় এসছে নাবীয়ে কারীম সা. এক বছর রমাদানে যুদ্ধে ব্যস্ত থাকার কারণে এতেকাফ করতে পারেননি তাই মাওয়াল মাসে দশ দিন রোজা রেখে সেই এতেকাফ কাযা করেছেন। এবং পরের বছর রমাদানে বিশ দিন এতেকাফ করেছেন।

হজরত আয়েশা রা: থেকে বর্ণিত, নবী করিম সা: এরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি রমজান মাসের শেষ ১০ দিন এতেকাফ করবে, সে দু’টি ওমরাহ ও দু’টি হজ আদায় করার সওয়াব পাবে।’ (বোখারি : ২৭২৪)

হজরত ইবনে আব্বাস রা: থেকে বর্ণিত রাসূলে পাক সা: বলেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে এতেকাফ করবে, আল্লাহ তায়ালা তার এবং জাহান্নামের আগুনের মধ্যে তিনটি পরিখার দূরত্ব সৃষ্টি করবেন, প্রত্যেক পরিখার প্রশস্ততা দুই দিগন্তের চেয়েও বেশি। (শোয়াবুল ঈমান : ৩৯৬৫)

এতেকাফের শর্ত :

এতেকাফের শর্তগুলো হলো

১. নিয়ত করা।

২. জামাত অনুষ্ঠিত হয় এমন মসজিদে এতেকাফ করা।

৩. এতেকাফকারী রোজাদার হওয়া।

৪. জ্ঞানসম্পন্ন মুসলমান স্ত্রী-পুরুষের জানাবাত ও মহিলারা হায়েজ-

নেফাস থেকে পাক হওয়া।

৫. পুরুষ লোক জামে মসজিদে এতেকাফ করা।

৬. সর্বদা হদসে আকবর থেকে পাক-পবিত্র থাকা।

 এতেকাফের প্রকার :

এতেকাফ ৩ প্রকার।

সুন্নত এতেকাফ : রমজানের শেষ দশকের এতেকাফ। অর্থাৎ ২০ রমজানের সূর্য ডোবার আগ মুহূর্ত থেকে শাওয়াল মাসের চাঁদ ওঠা পর্যন্ত মসজিদে এতেকাফ করা। এ ধরনের এতেকাফকে সুন্নতে মোয়াক্কাদা কিফায়া বলা হয়। গ্রাম বা মহল্লাবাসীর পক্ষে কোনো এক বা একাধিক ব্যক্তি এই এতেকাফ করলে সবার পক্ষ থেকে তা আদায় হয়ে যাবে।

ওয়াজিব এতেকাফ : নজর বা মানতের এতেকাফ ওয়াজিব। যেমন কেউ বলল যে, আমার অমুক কাজ সমাধা হলে আমি এত দিন এতেকাফ করব অথবা কোনো কাজের শর্ত উল্লেখ না করেই বলল, আমি এত দিন অবশ্যই এতেকাফ করব। যত দিন শর্ত করা হবে তত দিন এতেকাফ করা ওয়াজিব। ওয়াজিব এতেকাফের জন্য রোজা রাখা শর্ত। সুন্নত এতেকাফ ভঙ্গ করলে তা পালন করা ওয়াজিব হয়ে যায়।

নফল এতেকাফ : সাধারণভাবে যেকোনো সময় এতেকাফ করা নফল। এর কোনো দিন কিংবা সময়ের পরিমাপ নেই। অল্প সময়ের জন্যও এতেকাফ করা যেতে পারে। এজন্য মসজিদে প্রবেশের আগে এতেকাফের নিয়ত করে প্রবেশ করা ভালো। ওয়াজিব এতেকাফের জন্য রোজা রাখা শর্ত। জাহের রেওয়ায়েত মতে, নফল এতেকাফকারীর জন্য রোজা শর্ত নয়। কিন্তু ইমাম আবু হানিফা রহ:-এর মতে, নফল এতেকাফকারীর জন্যও রোজা রাখা শর্ত। যদি কেউ রোজা ব্যতীত এক মাস এতেকাফ মান্নত করে, তার প্রতি রোজা ব্যতীত এক মাস এতেকাফ ওয়াজিব হবে। যদি কেউ রমজান মাসে এতেকাফের মান্নত করে, তা হলে ভিন্নভাবে রোজা রাখার প্রয়োজন নেই। কিন্তু রমজান মাসে মান্নত আদায় না করলে পরবর্তী সময়ে রোজার সঙ্গে ওই এতেকাফ আদায় করতে হবে।

এতেকাফকারীর জন্য করনীয় হচ্ছে,

ঘুম খাওয়া-দাওয়া ব্যতিত বাকী সময় এবাদত করা । নাবীয়ে কারীম সা. এভাবে এতেকাফ করতেন। অতএব খুব বেশী করে নামাজ তেলাওয়াত যিকির আযকার তাসবিহ তাহলিল এবং এস্তেগফারে মশগুল থাকা ।

এতেকাফকারীর জন্য বর্জনীয় কাজসমূহ:

একান্ত প্রয়োজন ব্যতিত এতেকাফের স্থান থেকে বের না হওয়। অপ্রয়োজনিয় কথা বার্তা থেকে বিরত থাকা এবং অযথা সময় নষ্ট না করা।

আল্লাহ আমাদেরকে তাওফিক দান করুন। আমিন

রমাদানের শেষ দশকের গুরুত্বপূর্ণ আমল হলো এতেকাফ

পবিত্র লাইলাতুল কদর প্রাপ্তির সুনিশ্চিত প্রত্যাশায় সর্বোপরি মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য রমজানের শেষ দশকের এতেকাফ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ইবাদত।

রমজানের শেষ দশকের এতেকাফ রাসূলুল্লাহ সা:-এর গুরুত্বপূর্ণ একটি সুন্নাত আমল। রমজানের শেষ দশকের এতেকাফ সুন্নতে মোয়াক্কাদা আলাল কেফায়া। অর্থাৎ মহল্লার জামে মসজিদে কোনো রোজাদার মুসলিম এতেকাফ করলে সবার পক্ষ থেকে এ ধরনের সুন্নত আদায় হবে। তাই এলাকাবাসীর কেউ যদি এতেকাফ না করে তাহলে সুন্নত ছেড়ে দেয়ার কারণে সবার সুন্নত তরফের গোনাহ হবে।

এতেকাফ শব্দের শাব্দিক অর্থ হচ্ছে স্থির থাকা, আবদ্ধ থাকা, অবস্থান করা।

শরিয়তের পরিভাষায় নির্ধারিত সময়ে সওয়াব হাসিলের উদ্দেশ্যে পার্থিব ও জাগতিক সব ধরনের সংস্পর্শ ত্যাগ করে মসজিদে অবস্থান করাকে এতেকাফ বলে।

২০ রমজান সূর্যাস্তের কিছুক্ষণ পূর্ব থেকে ২৯ অথবা ৩০ রমজান অর্থাৎ ঈদুল ফিতরের চাঁদ দেখার পূর্ব পর্যন্ত পুরুষদের জন্য মসজিদে এবং নারীদের জন্য নিজ গৃহে নামাজের নির্ধারিত স্থানে নিয়মিত একাধারে অবস্থান করাকে এতেকাফ বলে।

শরিয়তের পরিভাষায় পাঁচ ওয়াক্ত সালাত জামাতসহকারে নিয়মিত আদায় করা হয় এমন মসজিদে মহান আল্লাহর ইবাদতের উদ্দেশ্যে নিয়তসহকারে অবস্থান করাকে এতেকাফ বলে।

এতেকাফের প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে লাইলাতুল কদর প্রাপ্তির মাধ্যমে মহান আল্লাহর একান্ত সান্নিধ্য লাভ।

পবিত্র কুরআনে সূরা বাকারার ১২৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন,‘আমি ইবরাহিম ও ইসমাঈলকে আদেশ দিয়েছিলাম যেন তারা আমার ঘরকে (কাবা) তাওয়াফকারীদের জন্য, এতেকাফকারীদের জন্য ও (সর্বোপরি তার নামে) রুকু-সিজদাহকারীদের জন্য পবিত্র রাখে।

এতেকাফকারী ব্যক্তি এতেকাফ অবস্থায় সকল প্রকার গুনাহ বেচে থাকেন এবং এতেকাফের পুরো সময় জুড়ে তার জন্য নেকী হতে থাতে ।

ফুকাহায়ে কেরামগণ বলেন, এতেকাফকারী ব্যক্তি যদি ফরজ ওয়াজিব এবং সুন্নতে মুআক্কাদা ব্যতিত অন্য কোন এবাদত নাও করেন তাও তিনি এতেকাফের ফজিলত পেয়ে যাবেন।

সহি বুখারীতে আব্দুল্লাহ ইবেন ওমর রা. থেকে একটি হাদীস বর্নিত হয়েছে, তিনি বলেন, নাবীয়ে কারীম সা. রমাদানের শেষ দশকে মসজিদে এতেকাফ করতেন।

সুনানে তিরমিযিতে আম্মাজান আয়েশা সিদ্দিকা রা. থেকে একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, নাবীয়ে কারীম সা. এন্তেকালের আগ পর্যন্ত প্রতি বছর রমাদানের শেষ দশকে এতেকাফ করেছেন।

কোন বর্ণনায় এসছে নাবীয়ে কারীম সা. এক বছর রমাদানে যুদ্ধে ব্যস্ত থাকার কারণে এতেকাফ করতে পারেননি তাই মাওয়াল মাসে দশ দিন রোজা রেখে সেই এতেকাফ কাযা করেছেন। এবং পরের বছর রমাদানে বিশ দিন এতেকাফ করেছেন।

হজরত আয়েশা রা: থেকে বর্ণিত, নবী করিম সা: এরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি রমজান মাসের শেষ ১০ দিন এতেকাফ করবে, সে দু’টি ওমরাহ ও দু’টি হজ আদায় করার সওয়াব পাবে।’ (বোখারি : ২৭২৪)

হজরত ইবনে আব্বাস রা: থেকে বর্ণিত রাসূলে পাক সা: বলেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে এতেকাফ করবে, আল্লাহ তায়ালা তার এবং জাহান্নামের আগুনের মধ্যে তিনটি পরিখার দূরত্ব সৃষ্টি করবেন, প্রত্যেক পরিখার প্রশস্ততা দুই দিগন্তের চেয়েও বেশি। (শোয়াবুল ঈমান : ৩৯৬৫)

এতেকাফের শর্ত :

এতেকাফের শর্তগুলো হলো

১. নিয়ত করা।

২. জামাত অনুষ্ঠিত হয় এমন মসজিদে এতেকাফ করা।

৩. এতেকাফকারী রোজাদার হওয়া।

৪. জ্ঞানসম্পন্ন মুসলমান স্ত্রী-পুরুষের জানাবাত ও মহিলারা হায়েজ-

নেফাস থেকে পাক হওয়া।

৫. পুরুষ লোক জামে মসজিদে এতেকাফ করা।

৬. সর্বদা হদসে আকবর থেকে পাক-পবিত্র থাকা।

এতেকাফের প্রকার :

এতেকাফ ৩ প্রকার।

সুন্নত এতেকাফ : রমজানের শেষ দশকের এতেকাফ। অর্থাৎ ২০ রমজানের সূর্য ডোবার আগ মুহূর্ত থেকে শাওয়াল মাসের চাঁদ ওঠা পর্যন্ত মসজিদে এতেকাফ করা। এ ধরনের এতেকাফকে সুন্নতে মোয়াক্কাদা কিফায়া বলা হয়। গ্রাম বা মহল্লাবাসীর পক্ষে কোনো এক বা একাধিক ব্যক্তি এই এতেকাফ করলে সবার পক্ষ থেকে তা আদায় হয়ে যাবে।

ওয়াজিব এতেকাফ : নজর বা মানতের এতেকাফ ওয়াজিব। যেমন কেউ বলল যে, আমার অমুক কাজ সমাধা হলে আমি এত দিন এতেকাফ করব অথবা কোনো কাজের শর্ত উল্লেখ না করেই বলল, আমি এত দিন অবশ্যই এতেকাফ করব। যত দিন শর্ত করা হবে তত দিন এতেকাফ করা ওয়াজিব। ওয়াজিব এতেকাফের জন্য রোজা রাখা শর্ত। সুন্নত এতেকাফ ভঙ্গ করলে তা পালন করা ওয়াজিব হয়ে যায়।

নফল এতেকাফ : সাধারণভাবে যেকোনো সময় এতেকাফ করা নফল। এর কোনো দিন কিংবা সময়ের পরিমাপ নেই। অল্প সময়ের জন্যও এতেকাফ করা যেতে পারে। এজন্য মসজিদে প্রবেশের আগে এতেকাফের নিয়ত করে প্রবেশ করা ভালো। ওয়াজিব এতেকাফের জন্য রোজা রাখা শর্ত। জাহের রেওয়ায়েত মতে, নফল এতেকাফকারীর জন্য রোজা শর্ত নয়। কিন্তু ইমাম আবু হানিফা রহ:-এর মতে, নফল এতেকাফকারীর জন্যও রোজা রাখা শর্ত। যদি কেউ রোজা ব্যতীত এক মাস এতেকাফ মান্নত করে, তার প্রতি রোজা ব্যতীত এক মাস এতেকাফ ওয়াজিব হবে। যদি কেউ রমজান মাসে এতেকাফের মান্নত করে, তা হলে ভিন্নভাবে রোজা রাখার প্রয়োজন নেই। কিন্তু রমজান মাসে মান্নত আদায় না করলে পরবর্তী সময়ে রোজার সঙ্গে ওই এতেকাফ আদায় করতে হবে।

এতেকাফকারীর জন্য করনীয় হচ্ছে,

ঘুম খাওয়া-দাওয়া ব্যতিত বাকী সময় এবাদত করা । নাবীয়ে কারীম সা. এভাবে এতেকাফ করতেন। অতএব খুব বেশী করে নামাজ তেলাওয়াত যিকির আযকার তাসবিহ তাহলিল এবং এস্তেগফারে মশগুল থাকা ।

 

একান্ত প্রয়োজন ব্যতিত এতেকাফের স্থান থেকে বের না হওয়। অপ্রয়োজনিয় কথা বার্তা থেকে বিরত থাকা এবং অযথা সময় নষ্ট না করা।

আল্লাহ আমাদেরকে তাওফিক দান করুন। আমিন

Leave a Reply